Monday, January 21, 2008

গুগল কথন ৫ - কর্মীরা যেখানে রাজা

গুগলের কর্মীদের সাথে কাজ করতে করতে অল্প দিন পরেই যেটা লক্ষ্য করি, সবাই প্রচন্ড কাজ পাগল। দিনে ৮ ঘন্টা কাজ করার জন্য গুগল পয়সা দেয়। কিন্তু গুগলের কর্মীরা অফিসে থাকে আরও অনেক বেশি সময়। কাজে আসার ক্ষেত্রে ধরাবাঁধা সময় নেই, যে যার মতো সময়ে আসতে পারে। অফিসে প্রথম দিনেই আমার বসকে প্রশ্ন করেছিলাম, কয়টার সময় আসতে হবে। রিচার্ড (আমার বস) বললো, তোমার যখন ইচ্ছা তখনই আসতে পারো। রিচার্ড আসতো সকাল নয়টার সময়, আর যেতো বিকাল ছয়টায়। আমি অবশ্য নয়টায় আসতামনা প্রতিদিন, যেতাম সাড়ে নয়টা বা দশটায়, আর বেরুতাম অফিস থেকে সাড়ে ছয়টা বা সাতটার দিকে। আমাদের গ্রুপের অন্য সদস্য ব্রায়ান এগারোটার দিকে এসে থাকতো রাত নয়টা সাড়ে নয়টা পর্যন্ত।

কাজে ডুবে থাকার এই সাধারণ প্রবণতাটার পেছনে কারণটা কি, বুঝতে শুরু করলাম কয়েক দিন পর থেকেই। সিলিকন ভ্যালিতে কাজ পাগল মানুষদের কষ্টের ফসল হিসাবে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, কিন্তু তাদের মধ্যেও গুগলের কর্মীদের অফিসে পড়ে থাকার আপ্রাণ চেষ্টাটা বেশি। আসলে এর পেছনের সবচেয়ে বড় কারণ হলো অফিসের পরিবেশটাকে অসাধারণ করে রাখা।

শুরুতেই বলা যায় অফিস ও তার আসেপাশের স্থাপনা। আমার অফিসটার পাশে ল্যান্ডস্কেপিং করে ফোয়ারা, জলপ্রপাত, আর মিনি সাইজের লেক বানানো। ফুলের বাগানে গুগলের লোগোতে ব্যবহৃত মৌলিক বর্ণের নানা ফুল সাজানো আছে বিচিত্র নকশায়। প্রথমবার গেলে পার্ক বলে ভ্রম হতে পারে।


অফিসের ভেতরে আবার খাবারের ছড়াছড়ি। আগেই বলেছিলাম একবার, অফিসের প্রতি ১৫০ ফুট পর পর একটা মাইক্রোকিচেন রয়েছে। এর মানে হলো, দুই তিনটা বিশাল ফ্রিজে ভর্তি রয়েছে খাবার থরে থরে - স্যান্ডউইচ, চকলেট, কম করে হলেও ১০-১৫ রকমের ফলের রস, ডাবের পানি, কোক/পেপসির ক্যান, স্পেশাল মিনারেল ওয়াটার, আর এনার্জি ড্রিংক। পাশের টেবিলে বাদাম, চিপস, ফল, বীফ জার্কি (মাংশের শুটকি), এরকম অনেক কিছু। আর কফি তো আছেই। সবই ফ্রি - যার যখন ইচ্ছা এসে খেয়ে যাচ্ছে, বা দু-হাত ভর্তি করে অফিসে নিয়ে যাচ্ছে ভুরি-ভোজনের জন্য।


এতো গেলো কেবল মাইক্রোকিচেনের কথা। প্রতিটা অফিস ভবনেই রয়েছে একটা করে ক্যাফে। পুরো গুগলপ্লেক্স এলাকাতে ভবন ১৬টা, তার মানে বুঝতেই পারছেন, ক্যাফের সংখ্যাও ১৬। আর ক্যাফেগুলো মোটেও গতানুগতিক নয়, একেকটা ক্যাফে একেকটা ধাঁচে সাজানো। যেমন আমার অফিসের ক্যাফের নাম "অফ দা গ্রিড", ওখানে একটু অন্য রকমের বিচিত্র প্রকারের খাবার দিতো। নিজের ইচ্ছে মতো সালাদ বানিয়ে নেয়া, সব্জ্বীর নানা রান্না, আর মাংশের কিছু আইটেম। প্রায় দিনেই অদ্ভুত সব খাবার আসতো, যেমন ক্যাঙ্গারুর বার্গার, হরিণের মাংসের কাবাব, এরকম। সপ্তাহে একদিন বারবিকিউ হতো বাইরে, ঐ যে লেক আর জলপ্রপাতের কথা বলেছি, তার পাশে চাদর বসিয়ে পিকনিকের মতো করে খাওয়া চলতো। আর সকালে প্রতিদিন থাকতো ডিমভাজি সহ নানা রকমের নাস্তা, বিকেল ৩টার সময় আবার বিকালের নাস্তা দিয়ে পেট পুজার ব্যবস্থা থাকতো।

পাশের ভবনেই ফাইভ নামের ক্যাফে, প্রতিটা খাবারে ঠিক ৫টা করে উপাদান দিয়ে তৈরী। আরেকটা ক্যাফে ছিলো ইউরোপীয় খাবারের। আরেকটা (প্যাসিফিক ক্যাফে) হলো চীনা, জাপানি সুশি ও অন্যান্য খাবারের। বিল্ডিং ৪৪এর ক্যাফেটা ছিলো স্লাইস - ওখানে রয়েছে দুর্দান্ত ফলের রস আর স্মুদি (লাসসি টাইপের)।

তবে সব কিচ্ছুকে ছাড়িয়ে যায় গুগলপ্লেক্সের কেন্দ্রস্থলের "চার্লিজ ক্যাফে"। গুগলের প্রথম শেফ ছিলো চার্লি, তবে বেতনের বদলে শুরুতে গুগলের শেয়ার পেতো বলে চার্লি এখন মিলিয়নিয়ার হয়ে রিটায়ার করেছে, তার নামেই এখন রয়ে গেছে ক্যাফেটা। বিশাল ফুটবল মাঠের সাইজের ঐ ক্যাফেতে ৫টা সাবক্যাফে ছিলো - নমস্তে হলো ভারতীয় খাবারের, পাশেরটা জাপানী খাবার আর ইতালীয় খাবারের ক্যাফে, তার সামনেরটা "ইস্ট মীটস ওয়েস্ট" অর্থাৎ ফিউশন ধাঁচের। এছাড়াও ছিলো মেক্সিকান খাবার আর গতানুগতিক মার্কিন/ইউরোপীয় খাবারের দুটো সাব ক্যাফে। এগুলোতে প্রতিদিন দুপুর আর সন্ধ্যাতে ভীড় হতো প্রচন্ড। পুরোটা অবশ্য প্রচন্ড সুশৃংখল, সবাই ট্রে নিয়ে লাইন বেঁধে খাবার নিয়ে টেবিলে, অথবা বাইরের মাঠে বসানো পিকনিক টেবিলে চলে যায়। প্রতিদিন কম করে হলেও হাজার চারেক কর্মী এখানে খেয়ে থাকে। ভারতীয় বা চীনারাতো মনে হয় বিকেল বেলাতে পুরো পরিবারের বাপ, মা, বাচ্চা কাচ্চা সহ গোটা দশেক লোক সাথে নিয়ে আসে। উল্লেখ্য, প্রত্যেকেই অতিথি নিয়ে আসতে পারে, কোনো বাঁধা নেই। আর খাওয়া যে ফ্রি, তা তো আগেই বলেছি।

গুগলের এই খাওয়ার অঢেল ব্যবস্থার কারণে নতুন আসা গুগল কর্মীরা হাপুস হুপুস করে খেতে থাকে, নিজের চোখে দেখা। "গুগল ফিফটিন" বলে কথা চালু আছে, গুগলে ঢোকার প্রথম দুই সপ্তাহে নাকি কর্মীদের ওজন বাড়ে ১৫ পাউন্ড অন্তত।

শুধু কি খাওয়াই মূল আকর্ষণ? মনে হয় না, কারণ গুগলের অন্যান্য ব্যবস্থাও চমৎকার। চুল কাটা দরকার? কোন সমস্যা নেই, গুগলের চুল কাটার মিনিবাস আছে একটা, সারা দিন অফিসে অফিসে ঘুরতে থাকে, জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে পেলেই নেমে গিয়ে চুল কেটে ফেলা যায়। গাড়ির অয়েল চেইঞ্জেরও ব্যবস্থা আছে। আর ঐ রাজভোগ খেয়ে ওজন বাড়লে ভুড়ি কমানোর জন্য রয়েছে জিম। বাচ্চাদের রাখার জন্য নার্সারি। ডাক্তার, ডেন্টিস্ট। আর কাজ করতে করতে অবসন্ন বোধ করলে ম্যাসেজ করার জন্য অটোম্যাটিক চেয়ার ম্যাসাজ, বা এক ঘন্টার টেবিল ম্যাসাজের ব্যবস্থাও রয়েছে। আর যাতায়াতের জন্যও অনেক ব্যবস্থা -- নিজের গাড়ি না থাকলে বা প্রতিদিন ড্রাইভ করতে ইচ্ছা না হলে গুগলের শাটল গিয়ে নিয়ে আসবে, এমনকি ৪০ মাইল দূরের সান ফ্রান্সিস্কো থেকেও অনেকে গুগলের বাসে করে আসে। আর গুগলের ইলেকট্রিক গাড়িও অনেক কর্মীকে দেয়া হয়, চালাবার জন্য।

আর সব সময় কাজ করা? তা নয় মোটেও, বরং খেলাধুলার ব্যবস্থা রয়েছে বিস্তর। ক্যাফের পাশেই ভলিবল কোর্ট, আর টেনিস খেলা, সাঁতার কাটা, কৃত্রিম স্রোতে সার্ফিং এর ব্যবস্থা, এসব তো রয়েছেই। কিন্তু তার চেয়েও ইন্টারেস্টিং হলো ভিডিও গেইমের কালেকশান, বাংলাদেশে আমরা যেমন খেলতাম কয়েন অপারেটেড মেশিন, সেরকম মেশিন সাজানো আছে। আমার অফিসের এক কোনাতে একটা বড় স্ক্রিন পেয়ে তো একজন দেখি রীতিমত ভিডিও গেইম কর্নার বানিয়ে ফেলেছিলো, উইই, পিএসপি, আর অন্য সব মেশিন দিয়ে।


সিলিকন ভ্যালির অন্যত্র অবশ্য এতোটা সুযোগ সুবিধা নেই। আমার বন্ধু কেউ কেউ ইন্টেলে কাজ করেছে, ওদের ক্যাফেতে নাকি পানিটাও কিনে খেতে হতো। গুগলের কর্মীরা থাকে রাজার হালে। অবশ্য এর পেছনে গুগলের লাভটাও অনেক। কর্মীদের এভাবে রাজার হালে রেখে রেখে অফিসে ধরে রাখাটা খুব সহজ হয়, সকাল থেকে এসে সবাই রাত করে ফিরে, মাঝের সময়টাতে পাগলের মতো কাজ করে চলে। আর মনে ফুর্তি আনার মতো সব ব্যবস্থা আছে বলে সারাদিন চরম উৎসাহে, আগ্রহে তৈরী করে চলে অসাধারণ সব সফটওয়ার।

Saturday, January 19, 2008

গুগল কথন - ৪ : ব্রিন আর পেইজের কথা

সের্গেই ব্রিন আর ল্যারি পেইজ গুগলের প্রতিষ্ঠাতা দুই টগবগে তরুণ। তাঁদের পরিচয় হয় স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পিএইচডি করার সময়, আর ঐ সময়েই দুজনে মিলে পেইজর‌্যাংক নামের একটি অ্যালগরিদম লিখেন। পেইজর‌্যাংকের মূল লক্ষ্য ছিলো ইন্টারনেটের ওয়েবপেইজগুলোর সম্পর্ক বের করা, কোনো পেইজের গুরুত্ব বের করে ঐ অনুযায়ী একটা ক্রম বের করা। ব্যাস, এই পেইজর‌্যাংক অ্যালগরিদমটিই সার্চ ইঞ্জিন হিসাবে গুগলের সূচনা করে দেয়। আগের সার্চ ইঞ্জিনগুলো কোন কোন ওয়েবপেইজে অনুসন্ধিত শব্দগুলো আছে, তা বের করতে পারতো, কিন্তু ওয়েবপেইজগুলোর র‌্যাংকিং ভালো ভাবে করতে পারতোনা বলে সার্চের ফলাফল ভালো আসতোনা।

সার্চ ইঞ্জিন হিসাবে গুগলের মান অনেক ভালো, এটা বোঝার পরে ব্রিন আর পেইজ গুগলকে একটা স্টার্ট-আপ কোম্পানি হিসাবে শুরু করেন ১৯৯৮ সালে। সিলিকন ভ্যালির অন্য অনেক নামজাদা কোম্পানির মতোই গুগলের যাত্রা শুরু হয় একটা গ্যারেজে, কিছু কম্পিউটার সার্ভার নিয়ে। গুটি কয়েক প্রোগ্রামার নিয়ে শুরু করা সেই গুগল আজ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে মূল্যায়িত এক মহীরূহে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু, ব্রিন আর পেইজকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। এখনও দুজনে মাটির মানুষ, ভাবভঙ্গীতে সেই পিএইচডি করতে থাকা গ্র্যাজুয়েট স্কুলের ছাত্রের মতো। গুগলে ইন্টার্নশীপ পাওয়ার সময় ভেবেছিলাম, পুরা গুগলের সবার বস ব্রিন, পেইজ, এবং গুগলের সিইও এরিক স্মিড্‌টকে আদৌ চোখে দেখতে পাবো কি না। বাংলাদেশে অন্য কারো কথা বাদ থাক, বুয়েটের শিক্ষকতা করার সময়েও বুয়েটের ভিসির সাথে দেখা করতে এক দিন ঘন্টা পাঁচেক বসে থাকতে হয়েছিলো। কোম্পানিগুলোর কথা তো বাদই দিলাম ... কোনো কোম্পানিতে সদ্য যোগ দেয়া কেউ কি আশা করতে পারে, কোম্পানির মালিকের সাথে সরাসরি কথা বলা বা বেফাঁস প্রশ্ন করা যাবে?

প্রথম দিনেই ধারণাটা পালটে গেলো, ব্রিন আর পেইজকে দেখে। প্রতি শুক্রবার গুগলে এক বিশাল পার্টি হয়। টিজিআইএফ, অর্থাৎ থ্যাংক গড ইটস ফ্রাইডে হলো এই পার্টির নাম। আসলে সোমবার থেকে কাজ শুরু হয়ে শুক্রবার আসতে আসতে মানুষের মেজাজ খিঁচড়ে যায়, কাজের চাপে মাথা গরম হয়ে থাকে। শুক্রবার আসলে আসন্ন দুই দিনের উইকেন্ড বা সপ্তাহান্তের ছুটির আনন্দে শুকরিয়া করে ... তাই থেকেই এই মিটিংটার নাম হয়েছে। যাহোক, এই মিটিং এর মোদ্দা কথা হলো, গুগলের বিশাল ক্যাফেটাতে হাজার কয়েক গুগল ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য কর্মী জড়ো হবে, বিশাল একটা খাওয়া দাওয়া চলবে, আর মঞ্চে দাঁড়িয়ে ব্রিন আর পেইজ গল্প গুজব করবে।

ওখানে হাজির তো অবাক। দেশে থাকতে দেখতাম, কোনো কোম্পানির বড়সাহেব, এমন কি সরকারী কোনো অফিসের জিএম সাহেবের বিশাল ভাব, আর আশে পাশে চামচার দল, অনেক সময় সিকিউরিটির লোকজনের হুমকি ধামকি। সে তুলনায় দুনিয়ার বিলিয়নিয়ারদের তালিকায় ২৬ তম স্থানে থাকা ব্রিন ও পেইজকে (প্রত্যেকের সম্পত্তির পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন ডলার করে) দেখে বোঝারই উপায় নেই, ওরাই এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এবং অধিকাংশ শেয়ারের মালিক। মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রতি শুক্রবার ওরা প্রথমে এই সপ্তাহে কি কি প্রডাক্ট গুগল ছাড়ছে, তার কথা বলে খানিক ক্ষণ। অনেক প্রডাক্ট, যেমন স্ট্রিট ভিউ, মার্কেটে আসার আগেই ভিতরের সবাইকে জানানো হয়। এর ফাঁকে ফাঁকে ব্রিন ও পেইজের ভাড়ামি চলতে থাকে, অনেকটা "ইত্যাদি" অনুষ্ঠানের মতো করে দুইজন নানা রকমের রসিকতা করতে থাকে। ব্রিনের জন্ম ও শৈশব কেটেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের কড়া সমাজতন্ত্রী শাসনে, সেটা নিয়ে ওকে পেইজ প্রায়ই ঠাট্টা করে। ব্রিনও কপট গাম্ভীর্য দেখিয়ে হাঁসাতে পারে ভালোই।

এর পরেই শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। এই পর্বে গুগলের কর্মীরা সরাসরি, বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রশ্ন করতে পারে ব্রিন, পেইজ, এবং এরিককে। আর এই পুরো ব্যাপারটাই খুব [ইংলিশ]transparent[/ইংলিশ], যে কোনো ধরণের প্রশ্ন যে কেউ নির্ভয়ে বলতে পারে। এমন কি গুগলের কোনো একটা পদক্ষেপ খুব বাজে এবং নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক, এরকম প্রশ্ন করতেও কোনো বাঁধা নেই। আমি যে কয়দিন এই অনুষ্ঠানে গিয়েছি, দেখেছি গুগলের কর্মীরা প্রত্যেক দিনই এরকম প্রশ্ন করছেন। যেমন, গুগল ভিডিও বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত কেনো নেয়া হলো, কেনো ইবে কে গুগল খেপিয়ে দিলো, এরকম। অনেক প্রশ্ন এমন, যেন ব্রিন ও পেইজকে রীতিমত জবাবদিহি করতে বলার মতো। ভাবতে পারেন, বাংলাদেশের কোনো কোম্পানির মালিকদের এরকম প্রশ্ন করা হচ্ছে, আর প্রশ্ন করছে একেবারে নতুন কর্মীরা? গুগলের চমৎকার পরিবেশে আসলে এটাই খুব স্বাভাবিক।

ব্রিন আর পেইজকে প্রশ্ন করার সুযোগ আমিও হাতছাড়া করিনি। অনলাইনে যে প্রশ্ন করার ব্যবস্থা আছে, তাতে শুক্রবার সকাল বেলা প্রশ্ন দিলে বিকাল নাগাদ ভোটাভুটিতে যে প্রশ্ন টিকে যায়, সেটাই করা হয়। বেশ কয়েক সপ্তাহ চেষ্টা করে আমার প্রশ্নটা একদিন প্রথম ১০টি প্রশ্নের মধ্যে আসলো। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, বাংলাদেশের দিকে গুগলের নজর কবে পড়বে, আর গুগল যেসব ভাষাকে প্রাধান্য দেয়, তাদের মধ্যে ২৫ কোটি লোকের মুখের ভাষা বাংলা কবে আসবে।

প্রশ্নের জবাব সের্গেই ব্রিন খুব আগ্রহের সাথেই দিলো। বললো, গুরুত্ব দেয়ার ব্যাপারটা অনেকটা অর্থনীতি ভিত্তিক। বাংলাদেশে কয়েক কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী আছে, তাই অচিরেই ঐ দিকে গুগল চিন্তা করবে, মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য কাজ করবে। আরেকটা ব্যাপার হলো, বাংলা ভাষায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কেমন, সেটা দেখতে হবে ... বাংলাদেশ থেকে যত মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাঁদের কতজন বাংলায় গুগল সার্চ করেন, ইংরেজি গুগলের বদলে, তাও বিবেচ্য। এসব কিছু বিবেচনা করে অচিরেই গুগল বাংলার উপরে কাজ শুরু করবে।

ব্রিন অবশ্য সিরিয়াস কমই থাকে, আগেই বলেছি। ব্যাগি প্যান্ট আর টি শার্ট পরা ব্রিনকে দেখলে মনে হয়, ইউনিভার্সিটির ল্যাব থেকে বেরিয়ে এসেছে এই মাত্র। পেইজকেও তাই। আর গুগলের প্রতিষ্ঠাতা হলেও চামচা বাহিনী নিয়ে ঘুরবে, বা তাঁদের ঘিরে বডিগার্ডের দল থাকবে, তা না। একদিন মজার ব্যাপার হলো, আমি সেদিন গিয়েছি বিল্ডিং ৪৩ এর নো-নেইম ক্যাফেতে। খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ মনে হলো, সামনের লোকটাকে চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছি ভাবতে ভাবতেই টের পেলাম, এটা সের্গেই ব্রিন। মনে হলো, ভলিবল কোর্টে অন্য কর্মীদের সাথে খেলে এসে এখন খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, অন্য সব সাধারণ গুগল কর্মীদের সাথে।

সিলিকন ভ্যালির সবাই বেশ ইনফর্মাল, তবে গুগলের মতো এতোটা না। ব্রিন আর পেইজের মতো মাটির কাছে থাকা মানুষদের দেখলে বোঝা যায়, কেনো গুগলের অন্য কর্মীরা এতো উৎসাহের সাথে কাজ করে থাকে। আর এজন্যেই কাজ করার জায়গা হিসাবে ফর্বস ম্যাগাজিনের জরীপে সব কোম্পানিকে পেছনে ফেলে গুগল এখন ১ নাম্বারে।

গুগল কথন - ৩ : গুগলপ্লেক্সের ভিতরে বাইরে


ইন্টার্নশীপের প্রথম দিনেই হাজির হলাম গুগলের সদর দপ্তরে। এতো বিখ্যাত কোম্পানি, কিন্তু নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি নেই। প্রথম দিনে লবিতে আমার ইন্টার্নশীপের কাগজপত্র আর আইডি দেখানোর পরে ছবি সহ গুগল ব্যাজ দেয়া হলো। ব্যাস, এই ব্যাজ থাকলে গুগলের সর্বত্র অবাধে আসা যাওয়া করা সম্ভব।

গুগলের প্রধান অফিসকে বলা হয় গুগলপ্লেক্স। প্রযু্ক্তির প্রাণকেন্দ্র সিলিকন ভ্যালির একেবারে কেন্দ্রস্থল মাউন্টেইন ভিউ শহরে এর অবস্থান। আসলে সান ফ্রান্সিস্কো হতে সান হোসে পর্য্ত প্রায় ৪০ মাইল লম্বা যেই উপদ্বীপ আকারের এলাকা, তার পুরোটাই আধুনিক প্রযুক্তি ভিত্তিক ব্যবসার কেন্দ্র। মাউন্টেইন ভিউ এর পাশেই স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, পালো আল্টো নামের শহরে। প্রযুক্তিগত বিভিন্ন বিষয়ে এখানে অভাবনীয় সব গবেষণা হয়ে চলেছে শ খানেক বছর ধরেই, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের দিক থেকেও এটা দুনিয়ার প্রথম কাতারে। নামজাদা সব মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, বিশেষত ইদানিংকার অধিকাংশ সফটওয়ার কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা অনেকেই এখানকার ছাত্র ছিলেন। গুগলের সের্গেই ব্রিন আর ল্যারি পেইজ তো বটেই, ইয়াহু!র প্রতিষ্ঠাতা ফিলো এবং ইয়াং, সানের প্রতিষ্ঠাতা ম্যাকনিলি, বিনোদ খোসলা - এরা সবাই স্ট্যানফোর্ডে পড়ার সময়ে বা পাস করেই নিজেদের কোম্পানিগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর সেই কারণেই পালো আল্টো বা মাউন্টেইন ভিউতে এই সব কোম্পানির সদর দপ্তর গড়ে উঠেছে।

ফিরে আসি গুগলপ্লেক্সের কথায়। গুগলের শুরুটা হয়েছিলো ব্রিন ও পেইজের এক বন্ধুর গ্যারেজে, মাত্র কয়েকটি কম্পিউটার নিয়ে। মেনলো পার্কের ঐ গ্যারেজে পরে গুগল চলে আসে পালো আল্টো শহরে। কিন্তু গুগলের অভাবনীয় সাফল্যের কারণে জায়গার দরকার বাড়তে থাকে অচিরেই। তাই ২০০৩ সাল এক কালের নামকরা কোম্পানি সিলিকন গ্রাফিক্সের ১৬০০ অ্যাম্ফিথিয়েটার পার্কওয়েতে অবস্থিত বিশাল হেড কোয়ার্টারটি গুগল ভাড়া নেয়। এখানে রয়েছে চারটি ভবন - বিল্ডিং ৪০, ৪১, ৪২, এবং ৪৩। আগেই বলেছিলাম, এই চারটি ভবনের মাঝখানের চত্ত্বরের বিশাল ডাইনোসরটির কথা। এছাড়াও মাঝখানের চত্ত্বরে রয়েছে একটি ভলিবল কোর্ট। সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেউ না কেউ খেলে বেড়াচ্ছে ... দেখলে মনে হবে অফিস নয়, বরং একটা হোটেলের খেলার কোর্ট। অনেকের কাছে শুনেছি, বিকেলের দিকে সের্গেই ব্রিন বা পেইজও নাকি যোগ দেয় খেলাতে। আমার অফিসটা অবশ্য একটু অন্যপাশে থাকায় সেই দৃশ্য দেখিনি।

এর পাশেই ক্যাফের চত্ত্বর। গুগলের সুবিখ্যাত খাওয়া দাওয়া নিয়ে পরে লিখবো। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেরা সেরা সব রেস্তোঁরার খাওয়াকেই গুগলের ক্যাফেগুলো হার মানায়। মোট ক্যাফের সংখ্যা এখানে ১৫টি। একেক ক্যাফে একেক রকমের - প্রধান ক্যাফেটা গুগলপ্লেক্সের বিল্ডিং ৪০এর চার্লিজ ক্যাফে। ওখানে এক সাথে প্রায় কয়েক হাজার লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় প্রতিদিন।

আমাদের ওরিয়েন্টেশন হয়েছিলো বিল্ডিং ৪৩ আর ৪২ এর বিশাল অডিটোরিয়ামে। প্রথম দিনের সব কাজ কর্ম শেষে পুরো গুগলপ্লেক্স ঘুরে দেখানো হলো। প্রতিটি তলাতেই একটু পর পর মাইক্রো কিচেন আছে, যাতে থরে থরে সাজানো আছে নানা রকম ফলের রস, চিপ্স, আইসক্রিম, ডাবের পানি, চকলেট, স্যান্ডউইচ থেকে শুরু করে কতো কি!! এই ব্যাপারে নাকি সের্গেই ব্রিনের একটা নীতি আছে, "কোনো মানুষকেই খাবার দাবারের থেকে দেড়শো ফুটের বেশি দূরে রাখা ঠিক না"। কাজ করতে করতে একটু খিদে পেলেই দূরে যাবার দরকার নেই, অফিস থেকে দুই পা হাঁটলেই একটা মাইক্রোকিচেন, আর সেখানে এরকম জিভে জল আনা সব খাবার।

গুগলপ্লেক্সের চারটি ভবন ছাড়াও এই এলাকাতেই কেবল গুগলের অফিস রয়েছে মোট ১৬টি। এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত প্রায় ২ মাইল দূরত্ব। আমার অফিসটি পড়েছিলো পশ্চিম পাশে। অবশ্য এক অফিস থেকে আরেক অফিসে যাবার জন্য অনেক ব্যবস্থা আছে। পুরো ক্যাম্পাসের প্রতিটি ভবনের সামনেই রয়েছে গুগলের মনোগ্রাম লাগানো বাই সাইকেল বা জি-বাইক। যে কেউ যে কোনো জি-বাইক নিয়ে অন্য অফিসের সামনে গিয়ে পার্ক করে রাখে, পরে আবার সেটা অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারে। তালা মারার ব্যাপার নেই। এটা ছাড়াও রয়েছে ইলেকট্রিক স্কুটার, শাটল বাস, এবং দুই চাকার অদ্ভুত যান সেগওয়ে। কিন্তু সবকিছুকে হার মানায় মাকড়শার মতো আকৃতির কনফারেন্স বাইক। প্রথম যেদিন দেখলাম, অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মাকড়শার অনেক গুলো পায়ের মতো এই বাইকের সাতটি বসার জায়গা বৃত্তাকারে বসানো, কেন্দ্রের একটি বিন্দুতে যুক্ত। বসার সময় কেন্দ্রের দিকে মুখ করে সবাই বসে। প্রতিটি সিটের নীচে প্যাডেল রয়েছে। সবাই প্যাডেল চালালে এক অদ্ভুত উপায়ে সেটা এক সাথে যুক্ত করে বাইকটিকে চালায়। আটজনের মধ্যে একজনের হাতে স্টিয়ারিং থাকে, সে এটা কোনদিকে যাবে তা ঠিক করে। আর এই বাইকের নাম কেনো কনফারেন্স বাইক হলো? আসলে গুগলের প্রকৌশলীরা কনফারেন্স রুমে মিটিং না করে অনেক সময় এই বাইকে মজা করে চালাতে চালাতে মিটিং করে থাকে, এমনকি ল্যাপটপে করে ইন্টারনেটে যোগাযোগ, সবই করা সম্ভব এটাতে।


গুগলপ্লেক্সে মোট কাজ করে হাজার ছয়েক মানুষ। এদের অজস্র গাড়ি পার্ক করার জন্য যে পার্কিং লট রয়েছে, গুগল সেটাকেও অন্যভাবে কাজে লাগিয়েছে। গুগলপ্লেক্সের স্যাটেলাইট ছবিতেই দেখবেন, পুরো গুগলপ্লেক্সের উপরের ছাদ, এমন কি পার্কিং লটের অনেক অংশের ছাউনির উপরে সোলার প্যানেল বসানো। এই সোলার প্যানেলগুলো থেকে প্রতিদিন যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যুত উৎপাদন করা হয় - দিনে গড়ে ২ মেগাওয়াটেরও বেশি। আর গুগলের নিজস্ব আরেকটা প্রজেক্ট হলো প্লাগ-ইন হাইব্রিডের গবেষণা, অর্থাৎ এমন গাড়ি বানানো, যা বাসার ইলেক্ট্রিক সকেটে প্লাগ ঢুকিয়ে চার্জ করে নেয়া যাবে।

থাক, আজ এতটুকুই, পরের পর্বে গুগলের বিখ্যাত খাবার দাবারের গল্প করা যাবে ...