Tuesday, June 1, 2010

যন্ত্র গণকের যন্তর মন্তর - ৩



(পর্ব ১) (পর্ব ২)

সাত্তার সারের ভাত ঘুম

শেষমেশ ভাত ঘুমটা আর জুত করে দেয়া গেলোনা ...

ক্লাস এইট সি-সেকশনের ক্লাস টিচার আবদুস সাত্তার স্যারের আজ মেজাজ বেজায় খারাপ। কলেজিয়েট স্কুলের সবচেয়ে বদমাশ ছাত্রদের ধরে ধরে ভরা হয়েছে এই শাখায়, আর এদের বাঁদরামি সামলাতে হয় উনাকেই। দুপুর পেরুলেই ক্লাস প্রায় ফাঁকা, ক’দিন আগে স্টেশন রোডের এক সিনেমা হল থেকে ৪০ জন ছাত্রকে হাতেনাতে ধরা হয়েছিলো। ইদানিং বেতেও কাজ হচ্ছে না, ছেলেপেলে অবস্থা বুঝে দুটো শার্ট পরে আসে যাতে ব্যথা না লাগে।

এহেন দুরন্ত ছাত্রদের সামলাতেই যেখানে দিন যায়, সেখানে হেড স্যার গোদের উপরে বিষফোঁড়ার মতো করে বাড়তি কাজ চাপিয়ে দিয়েছেন। সামনে স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, তার জন্য মার্চপাস্ট করাতে হবে ছাত্রদের দিয়ে; সাধারণত রশীদ স্যার এ কাজটা করেন, কিন্তু তিনি আজ ছুটিতে। তাই এই বাঁদরদের নিয়ে পিটি প্র্যাকটিস আজ তাঁকেই করতে হবে, কড়া এই দুপুরের রোদে। ছেলেপেলেগুলো প্রচন্ড দুষ্ট – আর তাদেরই কি না উচ্চতার ভিত্তিতে লাইন করে দাঁড় করিয়ে প্যারেড শেখাতে হবে।

প্রচন্ড খারাপ মেজাজ নিয়ে সাত্তার স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। বান্দরকুলশিরোমণি ছাত্র শফিককে সামনে পেতেই বেতালেন খানিকক্ষণ। তাতেও মেজাজ ভালো হলো না। বাঁদরগুলোকে লাইন করে ঠিকমতো দাঁড়াতে বললে তারা উলটো মশকরা শুরু করে দেয়, কে কোথায় দাঁড়াবে, তা উনাকেই ঠিক করতে হবে।

সময় হাতে অল্প, এর মধ্যে ৫০টা বাঁদর ছাত্রকে কীভাবে তিনি উচ্চতার ভিত্তিতে সাজাবেন?

----

আসুন, আজ দেখা যাক, সাত্তার স্যারকে আমরা কীভাবে সাহায্য করতে পারি ...

সর্টিং বা বাছাইকরণ

বাছাই করা, অর্থাৎ ক্রমানুসারে সাজানো তথ্য বিশ্লেষণের একটি মৌলিক সমস্যা। এক গাদা সংখ্যাকে ছোট থেকে বড়, কিংবা বড় থেকে ছোট, অথবা অনেকগুলো নামকে বর্ণানুক্রমিকভাবে সাজানো – এরকম সমস্যা আমাদের প্রতিনিয়তই সমাধান করতে হয়। কম্পিউটার বিজ্ঞানে এই সমস্যাটির সমাধানের কৌশলগুলোকে বলে সর্টিং অ্যালগরিদম। আজ আমরা দেখবো এই সর্টিং এর কিছু সহজ কৌশল।

সিলেকশন সর্ট

এই সর্টিং কৌশলের মূল ধারণাটা খুব সহজ। তালিকাকে ছোট থেকে বড়তে সাজাতে হবে? তাহলে প্রথম ধাপে তালিকার সবচেয়ে ছোট সংখ্যাটা খুঁজে নিন। সেটাকে আলাদা করে রাখুন। এবার বাকি গুলো থেকে সবচেয়ে ছোটটি বেছে নিন, আগের সংখ্যাটির পরে রাখুন এটাকে। এভাবে প্রতি ধাপে তালিকার বাকি অংশের সবচেয়ে ছোট সংখ্যা বেছে বেছে নিয়ে পেছনে যোগ করতে থাকুন, তাহলেই পরিশেষে পেয়ে যাবেন ছোট থেকে বড়তে বাছাই করা একটা তালিকা।

ধরা যাক, সাত্তার স্যারের সামনে আছে রফিক, শফিক, হিমাদ্রি, জুয়েল, ফারুক, ও দেবকান্ত। এদের উচ্চতা একেক রকম, রীতিমতো বাটকু শফিক যেমন আছে, সেরকম ঢ্যাঙা গোছের ফারুকও আছে। এদের উচ্চতাগুলো, ইঞ্চিতে, ধরা যাক, (৬৩, ৫৫, ৬৫, ৫২, ৭১, ৫৬)।

তাহলে প্রথম ধাপে আমরা পেলাম সবচেয়ে বেঁটে হলো শফিক, অর্থাত ছোট সংখ্যা, ৫২। শফিককে সাত্তার স্যার বললেন মাঠের মধ্যে লাইনের শুরুতে দাঁড়াতে। (ভেঙচি কাটা দেখে ফেলাতে বাড়তি শাস্তি হিসাবে কান ধরে দাড় করিয়ে রাখলেন)। যাহোক, অংকের হিসেবে ব্যাপারটা দাঁড়ালো এরকম, আমাদের হাতের তালিকার শুরুতে রাখলাম [৫২]। বাকি সংখ্যার তালিকাটা হলো (৬৩, ৫৫, ৬৫, ৭১, ৫৬), আর তার মধ্যে সবচেয়ে ছোট হলো ৫৫। সেটাকে হাতের তালিকার পেছনে রাখলে হয়, [৫২, ৫৫]।

বাকি সংখ্যার তালিকা (৬৩, ৬৫, ৭১, ৫৬), সেখানকার ক্ষুদ্রতম সংখ্যা ৫৬। তাকে বাছাই তালিকার পেছনে দিলে সেটা হয় [৫২, ৫৫, ৫৬]।

বাকি সংখ্যার তালিকা (৬৩, ৬৫, ৭১), সেখানকার ক্ষুদ্রতম সংখ্যা ৬৩। তাকে বাছাই তালিকার পেছনে দিলে সেটা হয় [৫২, ৫৫, ৫৬, ৬৩]।

বাকি সংখ্যার তালিকা (৬৫, ৭১), সেখানকার ক্ষুদ্রতম সংখ্যা ৬৫। তাকে বাছাই তালিকার পেছনে দিলে সেটা হয় [৫২, ৫৫, ৫৬, ৬৩, ৬৫]।

আর বাকি রইলো ৭১, (ক্লাসের সবচেয়ে ঢ্যাঙা ছোকরা গুঁফো ফারুক, তার উচ্চতা এখনই কলেজে পড়া ছেলেদের মতো!!)। ৭১ সেটা তালিকার সবচেয়ে বড় সংখ্যা, তাকে বাছাই তালিকার পেছনে জুড়ে দিলে পাই [৫২, ৫৫, ৫৬, ৬৩, ৬৫, ৭১]। ব্যস, বড় থেকে ছোটতে সাজানো হয়ে গেলো তালিকাটা।

আরেকটা উদাহরণ দেখা যাক নিচের ছবিতে (উৎসঃ উইকিপিডিয়া) -



এভাবে না হয় ৬ জন ছাত্রকে কম থেকে বেশি উচ্চতায় সাজানো গেলো, কিন্তু সময় কেমন লাগলো? এখানে দেখা যাচ্ছে, ছয় জনের জন্য ছয় ধাপ লেগেছে। আবার প্রতি ধাপে বাকি সংখ্যার তালিকার সবচেয়ে ছোটটি বের করতে হয়েছে। কাজেই মোট ছাত্রের সংখ্যা ক হলে এই পদ্ধতিতে সময় লাগছে গড়পড়তায় ক ধাপ x প্রতি ধাপে গড়ে ক’টি তুলনা, মানে গড়পড়তার গোজামিলে কxক।

এর চেয়ে দ্রুতও নিশ্চয় কাজটা করা সম্ভব? ৫০টা বাঁদর ছেলেকে এক এক করে এমন করে সাজাতে গেলে সারা দিন লাগবে, তাই সাত্তার স্যার এবার ক্লাসের ফার্স্ট বয় পার্থ, তাকে ডেকে কাজটা ধরিয়ে দিলেন। উনার আবার দুপুরের ভাতঘুমটা পেয়ে বসেছে।

বাবল সর্ট বা বুদ্বুদ বাছাই

পানি বা সাবান পানির মধ্যে স্ট্র ডুবিয়ে বুদবুদ বানিয়েছেন ছেলেবেলায়? কিংবা এখনো? যদি করে থাকেন তাহলে হয়তো দেখেছেন, বড় বুদবুদ অনেক দ্রুত ভেসে উঠে?

পার্থর মাথায় এলো এই বুদ্ধিটা, এক এক করে কে সবচেয়ে ছোট তা বের না করে অন্য পদ্ধতি খাটাবে। লম্বু কাউকে পেলেই লাইনের পেছনের দিকে ঠেলে দেবে।

যা বুদ্ধি সেই কাজ, পার্থ সবাইকে এক বারে লাইনে দাঁড় করিয়ে ফেললো। এর পর শুরু করলো এই কাজটা, প্রথমজন থেকে শুরু করলো। প্রত্যেককে পরের সাথে তুলনা করে, যদি আগেরজন পরের জনের চাইতে লম্বা হয়, তাহলে লম্বুজনের সাথে বেঁটেজনের জায়গা বদল করে দেয়। এভাবে শেষ জনের আগের জন পর্যন্ত যাবার পরে আবার প্রথম থেকে শুরু করে, তবে এবার শেষ জনের দুইজন আগে গিয়ে অদলবদল বন্ধ করে।

আবারও উদাহরণ হিসাবে (৬৩, ৫৫, ৬৫, ৫২, ৭১, ৫৬) তালিকাটা দেখা যাক।

প্রথম দুইজনের উচ্চতা ৬৩ ও ৫৫, কাজেই লম্বু ৬৩কে দ্বিতীয় স্থানে পাঠানোতে তালিকাটা দাঁড়ালো (৫৫, ৬৩, ৬৫, ৫২, ৭১, ৫৬)। এবারে দ্বিতীয় ও তৃতীয় জনের জোড়া (৬৩, ৬৫) এর মধ্যে ৬৫ লম্বু, কাজেই জায়গা বদলের দরকার নাই। তার পরের জোড়া (৬৫, ৫২) কে জায়গা বদল করে পাই (৫৫, ৬৩, ৫২, ৬৫, ৭১, ৫৬)। তার পরের জোড়া (৬৫, ৭১) ঠিক আছে। সর্বশেষ জোড়া (৭১, ৫৬) কে জায়গা বদল করানোতে পাওয়া গেলো (৫৫, ৬৩, ৫২, ৬৫, ৫৬, ৭১)।

এবার দ্বিতীয় পর্যায়ে একই কাজ শুরু থেকে করতে হবে, কিন্তু সবশেষের জায়গার লম্বু ফারুককে বাদ দিয়ে,

(৫৫, ৬৩, ৫২, ৬৫, ৫৬, ৭১) -> (৫৫, ৬৩, ৫২, ৬৫, ৫৬, ৭১) (১ম দুইজন ঠিক আছে)

(৫৫, ৬৩, ৫২, ৬৫, ৫৬, ৭১) -> (৫৫, ৫২, ৬৩, ৬৫, ৫৬, ৭১) (জায়গাবদল)

(৫৫, ৫২, ৬৩, ৬৫, ৫৬, ৭১) -> (৫৫, ৫২, ৬৩, ৬৫, ৫৬, ৭১) (ঠিক আছে)

(৫৫, ৫২, ৬৩, ৬৫, ৫৬, ৭১) -> (৫৫, ৫২, ৬৩, ৫৬, ৬৫, ৭১) (জায়গাবদল)

এবার ৩য় পর্যায়ে একই কাজ শুরু, কিন্তু সবশেষের লম্বু ফারুক, আর তার আগের হিমাদ্রীকে বাদ দিয়ে।

(৫৫, ৫২, ৬৩, ৫৬, ৬৫, ৭১) -> (৫২, ৫৫, ৬৩, ৫৬, ৬৫, ৭১) (জায়গাবদল)

(৫২, ৫৫, ৬৩, ৫৬, ৬৫, ৭১) -> (৫২, ৫৫, ৬৩, ৫৬, ৬৫, ৭১) (ঠিক আছে)

(৫২, ৫৫, ৬৩, ৫৬, ৬৫, ৭১) -> (৫২, ৫৫, ৫৬, ৬৩, ৬৫, ৭১) (জায়গাবদল)

এবার ৪র্থ পর্যায়েও একই কাজ শুরু, কিন্তু শেষের তিনজনকে বাদ দিয়ে। এভাবে করতে থাকলে আর দুই ধাপ পরেই আমরা পাবো সাজানো তালিকাটি, (৫২, ৫৫, ৫৬, ৬৩, ৬৫, ৭১)।



(বাবল সর্টের অ্যানিমেশন - উইকিপিডিয়া)

পার্থ অবশ্য এতো দূর যেতে পারেনি। স্যার একটু তন্দ্রাতে যেতেই ফারুক পার্থকে মনের সুখে কিছুক্ষণ গাট্টা দিলো। আঁতেল পোলার মাতব্বরী এই রোদে আর কাঁহাতক ভালো লাগে।

শোরগোল শুনে সাত্তার স্যারের ঘুমটা গেলো ভেঙে। এখনো কাজ হয়নি দেখে মেজাজ সপ্তমে চড়লো, তাই এক রাউন্ড শাস্তি শেষে দায়িত্বটা এবার দেঁড়েল কুদ্দুসকেই দিলেন।

মার্জ সর্ট বা জোড়া বাছাই

কুদ্দুস পড়ায় লবডঙ্কা হলেও কাজের বুদ্ধি প্রখর। বাবা দানু মিঞা সওদাগরের খাতুনগঞ্জের আড়তে বসতে হয়না এখনো, কিন্তু সেখানকার হালচাল ছোটবেলা থেকে দেখে আসাতে এই ধরণের কাজগুলো সহজে করে ফেলতে পারে। কেবল পরীক্ষার খাতাতেই কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না। এই নিয়ে ২ বার ফেল করে ক্লাস এইটেই আটকে আছে।

যাহোক, কুদ্দুসের মাথায় এলো, এতো ঝামেলা না করে কাজটাকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে ফেলা যাক। যেমন, আগের উদাহরণের তালিকাটা দেখা যাক। (৬৩, ৫৫, ৬৫, ৫২, ৭১, ৫৬) এই তালিকাটা এক বারে সাজানো কঠিন। তাই কুদ্দুস প্রথমেই এই তালিকাকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেললো (৬৩, ৫৫, ৬৫) আর (৫২, ৭১, ৫৬)।

বুদ্ধিটা হলো, এই দুইটা তালিকাকে প্রথমে সাজিয়ে ফেলবে, তার পর এদের দুই তালিকাকে একসাথে জোড়া লাগাবে।
(৬৩, ৫৫, ৬৫) তালিকাটাকে কীভাবে সাজাবে? একই রকম, দুই ভাগে ভাগ করে ফেলা হলো। মাঝের জনকে তো আর কাটা যায় না, তাই তালিকাটা না হয়, (৬৩, ৫৫) আর (৬৫) এভাবে ভাগ হলো।

এবার তো প্রথম তালিকাটা, মানে (৬৩, ৫৫) কে সাজানো সোজা, এদের জায়গা বদল করেই পাওয়া গেলো (৫৫, ৬৩)। তার সাথে (৬৫) এই তালিকাটাকে জোড়া লাগাবো কীভাবে? দুই পাশে দুই তালিকার ছাত্রদের দাঁড় করালো কুদ্দুস। তার পর দুই তালিকার সামনের মাথায় যারা আছে, তাদের তুলনা করলো, যে ছোট, তাকে নেয়া হলো। তাই প্রথমে ৫৫ আর ৬৫ এর তুলনা করে নেয়া হলো ৫৫কে। তার পরে ৬৩ আর ৬৫ এর তুলনা করে ৬৩কে, আর এর পর যেহেতু প্রথম তালিকা শেষ, তাই দ্বিতীয় তালিকার সবাইকে পরপর নিয়ে পাওয়া গেলো (৫৫, ৬৩, ৬৫)।

ব্যাস, শুরুর তালিকাটা গুছানো হয়ে গেলো, পরের ৩ জনের তালিকাটাও একইভাবে গুছিয়ে পাওয়া গেলো (৫২, ৫৬, ৭১)।

এবার কুদ্দুসের হাতে দুটো দল, (৫৫, ৬৩, ৬৫), আর (৫২, ৫৬, ৭১)। এদেরকে জোড়া লাগানোর কাজ শুরু করলো কুদ্দুস।

(৫৫, ৬৩, ৬৫), (৫২, ৫৬, ৭১), [ ] -> (৫৫, ৬৩, ৬৫), (৫৬, ৭১), [৫২] (৫৫ আর ৫২ এর মধ্যে ৫২ ছোট)

(৫৫, ৬৩, ৬৫), (৫৬, ৭১), [৫২] -> (৬৩, ৬৫), (৫৬, ৭১), [৫২, ৫৫] (৫৫ আর ৫৬ এর মধ্যে ৫৫ ছোট)

(৬৩, ৬৫), (৫৬, ৭১), [৫২, ৫৫]->(৬৩, ৬৫), (৭১), [৫২, ৫৫, ৫৬]

(৬৩, ৬৫), (৭১), [৫২, ৫৫, ৫৬] -> (৬৫), (৭১), [৫২, ৫৫, ৫৬,৬৩]

(৬৫), (৭১), [৫২, ৫৫, ৫৬,৬৩]-> ( ), (৭১), [৫২, ৫৫, ৫৬, ৬৩, ৬৫]

( ), (৭১), [৫২, ৫৫, ৫৬,৬৩]-> ( ), ( ), [৫২, ৫৫, ৫৬, ৬৩, ৬৫, ৭১]

ব্যাস, গুছানো শেষ। আর এতে ঝামেলাও কম হলো। ঠিক কতোটা কম, কুদ্দুস নিজেও টের পায়নি, কিন্তু আমরা অংক করে দেখতে পারি, ক জন ছাত্র থাকলে তাদের সাজাতে সময় লাগবে ক x log(ক) সময়, যা আগের দুটো পদ্ধতির চাইতেই অনেক কম।
মার্জ সর্টের বিভিন্ন ধাপের আরেকটি উদাহরণ দেখা যাক নিচের ছবিতে (সূত্রঃ উইকি),



পাদটীকা-

সর্ট বা বাছাইয়ের হাজারো পদ্ধতি আছে, একেক ক্ষেত্রে একেকটি প্রযোজ্য। কম্পিউটার ব্যবহারের প্রতিটি ক্ষণেই যন্ত্রগণক ভেতরে ভেতরে এই সর্টিং করে চলেছে, তাই দ্রুতগতির সর্টিং বা বাছাই পদ্ধতি কম্পিউটার বিজ্ঞানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সর্টিং সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে দেখতে পারেন উইকিপিডিয়াতে।

নামের বাহার, বাহারী নাম, ফরমুলাতে, ফেলেছি ঘাম (২)

(আগের পর্বের পর) স্কুলের ইতিহাস বইতে মোগল/পাঠান আমলের বিরক্তিকর ইতিহাস গিলতে হয়েছিলো, তাতে একটা ব্যাপার প্রায়ই দেখতাম, অমুকে তমুক জায়গার সিংহাসন দখল করে সুলতান হওয়ার পরে সমুক নাম ধারণ করেছেন।

সেই ধাঁচেই আজ থেকে আমি “জোজো মানু” নামটি ধারণ করলাম।

ঘাবড়ে গেলেন? নাহ, এটা আমার আকীকা দেয়া নাম নয়, কিংবা মায়ানগরের সিংহাসনেও চড়ে বসিনি, বরং এটা আমার আফ্রিকীয় নাম। আরো খোলাসা করে বলতে গেলে, এটা আমার ঘানার আকান গোত্রপদ্ধতির নাম।

ঘানার আকান জাতির এই নামের রীতি পশ্চিম আফ্রিকার অনেক দেশেই চালু আছে। এই পদ্ধতির চমৎকার দিকটা হলো, নাম রাখা নিয়ে কোনো ঝামেলা টামেলা নেই, “শিশুর সুন্দর নাম” জাতীয় বই, কিংবা দাদা-নানার চাপে পড়ে তুঘলকী আমলের নাম রাখারও ফ্যাকড়া নেই। পুরো নামটা চমৎকার এক ফরমুলাতে পড়ে।

দেখা যাক, ফরমুলাটা কী রকম।আকানদের নিয়ম অনুসারে নাম হবে দুই অংশের – প্রথম অংশটি হবে সপ্তাহের কোন বারে জন্ম হয়েছে, সেই বারের নাম। আর দ্বিতীয় অংশে থাকবে বাবা-মার কতো নম্বর সন্তান, সেটা।

ঘানার কফি আন্নান এর কথা নিশ্চয় মনে আছে সবার? ভদ্রলোকের নাম কফি আন্নান কেনো হলো, তা জানতে হলে ঘানার এই জাতিগোষ্ঠীর নামের কায়দাটা বুঝতে হবে। কফি মানে হলো শুক্রবার, আর আন্নান মানে চার নম্বর। সব মিলে বোঝা যায়, জাতিসংঘের এই সাবেক মহাসচিব ছিলেন বাবা-মার চার নম্বর ছেলে সন্তান, যার জন্ম শুক্রবারে।
কফি যদি মেয়ে হতেন, তাহলে তাঁর প্রথম নামটি হতো আফিয়া। দিনভিত্ত্বিক নামের তালিকাটি নিচে দিয়ে দিলাম, এই সিস্টেমে সহজেই নিজের আফ্রিকীয় নামটি বানিয়ে নিতে পারেন।

(বার) -- (ছেলের নাম) -- (মেয়ের নাম)

সোমবার – কোয়াদ্দো বা কোজো বা জোজো - আদজোয়া
মঙ্গলবার – কোয়াবেনা / কোবি – আবিনা
বুধবার – কোয়াকু/কোকু – আকুয়া/আকুবা
বৃহস্পতিবার – ইয়াউ/ইয়াবা/ বাবা/আবা – ইয়ায়া
শুক্রবার – কফি – আফিয়া
শনিবার – কোয়ামে – আম্মা / আমা
রবিবার – আকওয়াসি/ কোয়েসি/ সিসি – আকোসুয়া

আর ক্রমবাচক নামের পদ্ধতি হলো
১ম সন্তান – পিয়েসি বা বার্কো/অর্কো,
২য় সন্তান – মানু বা মাআনু
৩য় সন্তান – মেনসা বা মানসা
৪র্থ সন্তান – আনান বা আন্নান
৫ম সন্তান – নুম বা আনুম
৬ষ্ঠ সন্তান – নসিয়া বা এসিয়েন
৭ম সন্তান – আসোন বা নসোয়া
৮ম সন্তান – বতওয়ে
৯ম সন্তান – আক্রোন বা নক্রুমা
১০ম সন্তান – বদু বা বদুয়া
১১শ সন্তান – দুকু
১২শ সন্তান – দুনু
সবচেয়ে ছোট সন্তান - কাকিয়ে

আবার কী অবস্থাতে জন্ম সেটাও অনেক সময় নামের অংশ হতে পারে, যেমন মাঠে ঘাটে জন্ম হলে আফুম, যুদ্ধাবস্থায় জন্ম হলে বেকু, এরকম।

এবার বলুন তো, কোয়ামে নক্রুমা কী বারে জন্মেছিলেন, আর কত নম্বর সন্তান?

ছক তো দিয়েই দিলাম, এবার চটপট নিজের আফ্রিকীয় নামটি বের করে নিন।

-----------------------

এবার আফ্রিকা থেকে চলে আসি আমাদের পড়শী বার্মার দিকে। নামের দিক থেকে বর্মীদের মতো স্বাধীনতা আর কেউ পেয়েছে কি না সন্দেহ। বর্মী নামের কোনো সিস্টেমই নেই। এমনকি জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম ধারণ করাটাও সেখানে স্বাভাবিক। আর নাম পাল্টাতে হলে সরকারী খাতায় অফিসে দৌড়াদৌড়িরও দরকার নেই।

আর নাম? বর্মীদের অনেকেরই নাম আগে ছিলো এক syllable বিশিষ্ট। হুমায়ুন আহমেদের বইতে বোধহয় পড়েছিলাম, কারো বাচ্চার নাম “নু” রাখা নিয়ে রসিকতা। বর্মীদের কিন্তু এরকম নাম রাখারই চল ছিলো শখানেক বছর আগেও। বিংশ শতকে এসেই কেবল তারা দুইধ্বনির নাম রাখা শুরু করে। কিন্তু তার মধ্যেও অনেক অংশ আসলে “চাচা”, “আংকেল” এই ধরণের। উদাহরণ দেই, বার্মার প্রথম প্রধানম্পন্ত্রীর নাম ছিলো “উ নু” (U Nu), তাঁর নামের প্রথম অংশ উ আসলে বোঝায় “জনাব” বা “মিস্টার” (অথবা সম্মানার্থে আমরা যেমন বলি “চাচা”, সেরকম)। তাঁর আসল নামটি হলো কেবলই “নু”।

আগের উদাহরণের কফি আনানের মতোই জাতিসংঘের আরেক মহাসচিব ছিলেন বর্মী কূটনীতিক উ থান্ট। যথারীতি, তাঁর নামেরও উ অংশটি হলো জনাব, আর থান্ট হলো তার আসল নাম।

অনেক সুপরিচিত বর্মীরই নামের অধিকাংশ অংশ এরকম জনাব বা “চাচা” বা “আন্টি” এরকম বোঝায়। যেমন, মহিলাদের নামে ব্যবহৃত “দ” (Daw) এর অর্থ হলো “বেগম”। মং হলো ছোটভাই। সায়াদও হলো পণ্ডিত, বোগইয়োক মানে সেনাপতি। মিন মানে রাজা।

সুপরিচিত বর্মী রাজনীতিবিদ অং সান সু কীর নামের ব্যাপারটা অনেকাংশে আধুনিক নামকরণ রীতির উদাহরণ। গত বেশ অনেকদিন ধরেই চল শুরু হয়েছে বার্মায়, বাবা মার নাম নামের পেছনে যোগ করে দেয়া। সু কীর নামের প্রথম অংশ “অং সান” আসলে সু কীর জন্মের সময়ে তাঁর বাবার যে নাম ছিলো, সেটাই। সু হলো তাঁর দাদীর নাম। আর কী হলো তাঁর মায়ের নাম।

সুকীর বাবা অং সানের নাম জীবনের শেষদিকে এসে হয়ে যায় বোগইয়োক অং সান, কারণ ততদিনে তিনি সেনাপতি হয়ে গিয়েছিলেন। অং সানের বাবার নাম ছিলো উ ফা (মানে জনাব ফা), আর মায়ের নাম ছিলো দ সু, নামে বেগম সু।

---------------

বর্মী নামের প্যাঁচে পড়ে মাথা ঘুরতে শুরু করেছে? তাহলে চলুন ঘুরে আসি কোরীয় উপদ্বীপ থেকে।

কোরিয়ার কারো সাথে যদি পরিচয় থাকে , তাহলে প্রায় অবধারিত ভাবে বলতে পারি,তার পদবীটি হবে কিম, লী, পার্ক, চো/কো, কিংবা চ্যান (বা চ্যাং, ঝ্যাং)। কোরীয়দের পদবীর ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য একেবারেই নেই। কোরিয়ার পদবীর পরিসংখ্যানটা দেখুন, ২২% লোকের পদবী কিম, ১৪% এর লী, ৮.৫% হলো পার্ক, আর ৪% করে কো/চো এবং চ্যাং/ঝ্যাং। কোরিয়ায় মোট পদবীর সংখ্যা ২৫০টি হলেও পার্ক/লী/কিম এরা মিলে দখল করে রেখেছে ৪৫% । তাই ঠাট্টা করে বলা হয়, কোরিয়ার কোনো রাস্তাতে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে একটা ঢিল ছুড়লে সেটা মিস্টার পার্ক, মিস্টার কিম বা মিস্টার লী’র গায়ে গিয়ে লাগবেই।

গুজব চালু আছে, কোরীয়দের মধ্যে নাকি ছেলে মেয়ের পদবী এক হলে বিয়ে করা মানা।আসলে ব্যাপারটা ওরকম ভয়াবহ না, কোরিয়ার রীতি অনুযায়ী প্রতি পরিবারের পদবী ছাড়াও “বন” বলে গোত্রসূচক আরেকটা নাম আছে। বিয়ের নিয়ম হলো, বন আর পদবী এক হলে বিয়ে করা মানা। একই পরিবার বা গোত্রের মধ্যে বিয়ে এড়াতে এই রীতি চালু করা হয়েছে।

কোরীয়দের নামের আরেকটা ব্যাপার হলো প্রজন্ম নাম। মানে একই পরিবারের ভাই বোন বা চাচাতো ভাইবোনদের নামের মাঝের অংশটি এক হবে, আর সেটা হলো সেই প্রজন্মের নাম।

সব মিলে কোরীয়দের নামের ফরমুলা হলো : পদবী, প্রজন্মনাম, ব্যক্তিগত নাম

অবশ্য অনেক সময়ে ব্যক্তিগত নামটা মাঝেও বসতে পারে।

যেমন, কোরীয়ার বর্তমান নেতার নাম কিম জং ইল। এখানে কিম হলো পদবী, জং হলো তাঁর ব্যক্তিগত নাম, আর “ইল” হলো প্রজন্মের নাম। নেতার ভাইয়ের নাম কিম পিয়ং ইল। আর নেতার তিন সন্তানের নাম হলো কিম জং নাম, কিম জং চুল, আর কিম জং আন । মানে এই প্রজন্মের নাম হয়েছে জং।

(চলবে)

(বাংলাদেশীদের নামের ফরমুলার প্রজেক্টের কথা মাথায় আছে। পরে এক সময় দেয়া হবে, আপাতত চা খেতে গেলাম বলে লেখার সময় পেলাম না, আর ব্লগের মলাটে জায়গা এতো কম , ফরমুলাটা পুরো লিখতেও পারছি না, নইলে দেখিয়ে দিয়েই ছাড়তাম ... )

(তথ্যসূত্র ও ছবি - উইকিপিডিয়া)

নামের বাহার, বাহারী নাম, ফরমুলাতে, ফেলেছি ঘাম


বাঙালিদের নামের গড়ন কেমন, এই নিয়ে কৌতুহল জেগেছিলো এক সময়। গণকবিদ্যাতে মাথা নষ্ট করার সুবাদে অভ্যাস হয়ে গেছে, সবকিছুর অ্যালগরিদম খোঁজা। তাই বাঙালিদের নামের রেগুলার এক্সপ্রেশন তথা কোন ফরমুলাতে বাঙালি নাম বানানো চলে, তা নিয়ে চিন্তা করতে গেলাম।

গিয়ে বেমক্কা ঝামেলা, বিদেশী যেমন ইংরেজদের বা মার্কিনীদের মতো বাঙালি নামের তো আগা মাথা নেই। উদাহরণ দেই -- মার্কিনীদের নাম হয় অনেক সময়েই ত্রিপদী -- প্রথম নামটিকে ওরা খ্রিস্টীয় নামও বলে, মাঝের নামটি ওরা কালে ভদ্রে ব্যবহার করে, তবে প্রায় সবারই থাকে, আর দাদী নানী চাচা খালা মামা ইত্যাদি আত্মীয়দের কারো নামে দেয়া হয় বলে শুনেছি, আর শেষের নামটি? সেতো মার্কিনীদের বংশপরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজেই মার্কিনী নামের ফরমুলা অনেকটা এরকম


মার্কিনী নাম = (প্রথম নাম) (মাঝের নাম)? (শেষ নাম)

(কম্পু-অবিজ্ঞানীদের জন্য টীকা, ? চিহ্নটি বোঝাচ্ছে এই অংশটি ০ বা ১ বার থাকবে, মানে মাঝের নাম একটি হবে অথবা থাকবেই না।)

অনেকের আবার সিনিয়র জুনিয়র, ৩নম্বর এমন লেজুড় থাকে, সেটাকে ফরমুলাতে যোগ করলে পাই


মার্কিনী নাম = (প্রথম নাম) (মাঝের নাম)? (শেষ নাম) (ক্রমবাচক)

এখানে প্রথম নামটি আবার অনেক ক্ষেত্রেই বাইবেলে বর্ণিত শ-কয়েক নামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, যদিও শেষ নামটি অজস্র অজস্র রকমের হয়। তাই দেখবেন, মার্কিনী বা ইংরেজদের প্রথম নাম টম,জন, পিটার, উইলিয়াম, জর্জ -- এইসব বাইবেলীয় মহামণিষীদের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে, কোনো ক্লাসরুমে "জন, কৈ গেলা" বলে ডাক দিলে হয়তো গোটা দশেক জন জবাব দেবে।

রুশদের নামেরও ফরমুলা আছে, যেমন

রুশ নাম = (ব্যক্তিগত নাম) (বাপের নাম) (গুষ্টির নাম)

যেমন, ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন মানে হলো এই চাঁদুর নাম হলো ভ্লাদিমির, বাপের নামও ভ্লাদিমির, আর তাদের বংশের নাম পুতিন।

আরবদের নামের বিশাল সিস্টেম, তাদের নাম হলো এরকম


আরব নাম = (ইসম) | (কুনিয়া) | (নাসাব) | (লাকাব) | (নিসবা)

(গণকদের উদ্দেশ্যে বলি, কিছুটা গন্ডগোল আছে ফরমুলাতে, এগুলোর ক্রম এরকম নাও হতে পারে সব ক্ষেত্রে)
যেখানে ইসম হলো ব্যক্তিটির মূল নাম, কুনিয়া হলো তার ছেলে/মেয়ের থেকে আসা নাম, নাসাব হলো পিতৃবংশের নাম, লাকাব হলো উপাধি জাতীয় নাম যা দিয়ে ব্যক্তিটির বৈশিষ্ট্য বোঝায়, আর নিসবা হলো ব্যক্তিটির পেশা।

মাথায় প্যাঁচ খাবার আগে একটা উদাহরণ দেই,

আবু করিম মুহাম্মদ আল-জামিল ইবনে নিদাল ইবনে আবদুলআজিজ আল ফিলিস্তিনি


এর মানে হলো, করিমের বাপ, মুহাম্মদ, দেখতে বড় সুন্দর, নিদালের ছেলে, আবদুল আজিজের নাতি, ফিলিস্তিননিবাসী।

দক্ষিণ ভারতীয়দের নামের আবার বেজায় অদ্ভুত সিস্টেম। ওদের নাম সর্বসাকুল্যে একটাই হয়। লাস্ট নেইম, সারনেইমের বালাই নেই। (আমার এই সিস্টেমটা বেশ পছন্দ হয়েছিলো, কিন্তু তার পর মনে হলো আমার স্কুলের ক্লাসে চারজন বাবু ছিলো, তাদের এক পর্যায়ে বাবু-১ থেকে বাবু-৪ পর্যন্ত নাম্বারিং করা হয়েছিলো)!

উদাহরণ হিসাবে এই ভদ্রলোকের নাম দেখুন - অরবিন্দ নামটাই তিনি ব্যবহার করেন কেবল। সামনে পিছনে কিছু নেই। এমনকি ওনার রিসার্চ পেপারগুলোতেও একই অবস্থা (ভাবখানা অনেকটা বাংলা সিনেমার নায়কদের মতো, এক নামেই পরিচিত)।

নাম তো আর অঢেল নেই, তাই বাবু-১ থেকে বাবু-৪ এর মতো দশা সহজেই হতে পারে, তা এড়াতে অনেক সময় দক্ষিণ ভারতীয়রা নিজেদের পেশা বা বর্ণ বা বাড়ির নাম লাগিয়ে দেয়। অথবা লাগিয়ে দেয় বাপের নাম।

কিন্তু আরো ইন্টারেস্টিং হলো এদের আদ্যাক্ষর পদ্ধতি -- ধরা যাক একই ক্লাসে দুইটা গোপাল আছে, একজনের বাপের নাম রাম, আরেকজনের বাপের নাম শ্যাম। এখানে দক্ষিণীরা সহজ সিস্টেম করে ফেলেছে, স্কুলের খাতায় নাম লেখাবার সময়ে প্রথমজনের নাম হবে আর. গোপাল (R. Gopal), আর দ্বিতীয় জনের হবে এস গোপাল (S Gopal)। এজন্য অনেক দক্ষিণীর নামেই দেখবেন এরকম আদ্যাক্ষর, কিন্তু ওটা দিয়ে কী হয়, তা আর বলা নেই। যেমন বিখ্যাত গণিতবিদ রামানুজানের নাম খুঁজলে দেখবেন, এস রামানুজান। এস দিয়ে অনেক খানে "শ্রীনিবাস" হয়, তা বলা আছে, কিন্তু আসলে এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝেই ফেলেছেন, রামানুজানের বাপের নাম ছিলো শ্রীনিবাস, আর রামানুজান মোটেও তাদের পদবী টদবী না।

চীনাদের নামের সিস্টেম আবার উলটো, মানে বংশপদবী আগে, তার পর বসবে নাম। অবশ্য বিদেশে আসলে অন্যদের সুবিধার জন্য ওরা নিজের নামটাও উলটে নেয়। তাই হং চ্যাং জাতীয় কারো নাম যদি দেখেন মার্কিন মূলুকে, তাহএল বুঝবেন চীনারা নিজদেশে তাকে চ্যাং হং বলেই ডাকবে।

----------

শুরুটা করেছিলাম বাঙালি নামের ফরমুলা বের করার ইচ্ছা নিয়ে, কিন্তু লেখা বিশাল হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই, তাই যতি টানলাম এখানেই। ৩ ফুটি তুষারে চাপা পড়েছে মায়ানগর, আঁতেল শিরোমণি দুই একজন ছাত্র ছাড়া আর সবাই লেপমুড়ি দিয়ে রয়েছে, তাই পড়াবার ঝামেলা থেকে মুক্ত আপাতত। কাজেই বাঙালি নামের ফরমুলাটা নাহয় আগামী পর্বের জন্যই জমা থাক ...

(শিরোনামটি অর্থহীন ছড়ার অপচেষ্টা। নাম এর সাথে "দাম", "ঘাম", "গাম", "চাম", "জাম", "ধাম" এসবের মিল পেলেও মাথায় আর কিছু আসলোনা। কাজেই আপাতত এটাই শিরোনাম রইলো)

ব্যানের রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়

ইতিহাসের আদিলগ্নে যখন থেকে মানুষ লিখতে শিখলো, তখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে তথ্যগোপনের যুগ। শাসক গোষ্ঠী, কিংবা ধর্মগুরুদের হাতে অপছন্দের বা বিপরীত রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতাদর্শের তথ্য নিপীড়িত হয়েছে, বাধা দেয়া হয়েছে তথ্যের অবাধ বিস্তারে।

সেন্সরশীপের রীতিমত প্রাতিষ্ঠানিক রূপটি দিয়েছিলো রোমান সভ্যতা। ৪৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে স্থাপিত হয় সরকারী সেন্সরশীপ দপ্তর, যার কাজ ছিলো ক্ষমতাশালীদের বিরুদ্ধে যায়, এমন সব তথ্য, জ্ঞান বা মতবাদের উপরে খড়গহস্ত হওয়া। সেসময়ের অন্য সভ্যতাগুলোও তৎপর হয়ে ওঠে সেন্সরশীপে, গণতন্ত্রের জন্মভূমি গ্রিসেও চালু হয় বিরোধীপক্ষীয় মতবাদ ব্যান করার প্রয়াস। এই গ্রিক সেন্সরের হাতে বলি হতে হয় দার্শনিক সক্রেটিসকে, ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সক্রেটিসের মতবাদকে সেন্সর করা হয় হেমলক বিষের মরণকামড়ে।

প্রাতিষ্ঠানিক সেন্সরশীপ কঠোরতর হয় রোমান ক্যাথলিক চার্চের হাতে। অখ্রিস্টান, কিংবা খ্রিস্টধর্মের অন্যান্য শাখার, বা বিজ্ঞানের বিভিন্ন মতবাদ, অথবা বইপত্র গণহারে নিষিদ্ধ হতে থাকে চার্চের হাতে। ১৫৫৯ সালে পোপ চতুর্থ পল নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকা প্রকাশ করেন। সভ্যতা এগিয়ে গেলেও বইপত্র সেন্সর করা কিন্তু থামেনি, নিষিদ্ধ বইয়ের এই তালিকাটি প্রকাশ পেয়ে চলেছিলো বিংশ শতকেও, মাত্র ১৯৬৬ সালে এই তালিকাটি ভ্যাটিকান প্রত্যাহার করে নেয়।

রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন মতামত/তথ্য সেন্সর করার রীতি সব স্বৈরাচারী সরকারই চালু রেখেছে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে। নাৎসি জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শুরু করে হালের বার্মা কিংবা গণচীনের সরকার চেষ্টা করে চলেছে জনগণকে তথ্যবঞ্চিত করে রাখার, দ্বার বন্ধ করে তথ্যকে রোখার। ছাপা বইপত্রের আমলে এটা করা ছিলো বেশ সহজ। সরকারই যেখানে ছাপাখানাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম, সেখানে গোপনে ছাপা বা হাতে লেখা ছাড়া অন্য সব কিছুকে দমন করা চলে সহজেই।

দমন-পীড়ণে পারঙ্গম এই তথ্য-খেকো সরকারগুলোর সমস্যা করে দেয় ইন্টারনেট। নব্বইয়ের দশকে গবেষণাগার থেকে আম-জনতার কাছে ছড়িয়ে যাওয়া এই ইন্টারনেটে তথ্য বিস্তার পেয়ে চলে দুর্দম গতিতে; দেশ স্থান কাল নির্বিশেষে তথ্যের অবাধ চলাচল শুরু হয়ে যায় সারা বিশ্বে। ইন্টারনেটের এই সর্বব্যাপ্ত রূপটির কারণে তথ্য সেন্সর করা হয়ে যায় রীতিমত অসম্ভব। আগে যেখানে দেশের ভেতরের বিরোধীমতবাদের কর্মীটিকে পুলিশী হয়রানী কিংবা নির্যাতন করে চাপা দেয়া যেতো তার কণ্ঠকে, সেখানে ইন্টারনেট দেশের সীমার বাইরে ছড়িয়ে দেয় সেই তথ্যের বিস্তার। দেশের জেলে-রিমান্ডে কাউকে পুরে তথ্য চাপা দেয়া চলে, কিন্তু ইন্টারনেটের আমলে হয়তো সেই তথ্যটি রয়েছে দুনিয়ার অপর প্রান্তের কোনো সাইটে, যেখানে তথ্যখেকো সরকারের দলবলের প্রভাব নেই।

তাই ইন্টারনেট সমস্যা করে দেয় গণচীন, ইরান, বার্মা, কিংবা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোর। চীনে গণতন্ত্রকামী তরুণদের অভাব নেই, তারা চায় তাদের দেশের বর্তমান ব্যবস্থার সমস্যাগুলোর সমাধান। ইন্টারনেটের এই সর্বব্যাপ্ত তথ্য জোয়ার ঠেকাতে শুরুতে অনেক কায়দা কৌশল খাটানোর প্রয়াস চলে। বাংলাদেশের ফেইসবুক বা ইউটিউব ব্যানের মতো অতি সাধারণ কৌশল, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকা ইন্টারনেট গেইটওয়েতে ব্যান করে দেয়া হয় বিভিন্ন সাইট। কিন্তু এসব কৌশল খুব সহজেই এড়ানো যায়, প্রক্সি সার্ভার দিয়ে এসব বাধা এড়ানোটা রীতিমত ডাল-ভাত।

চীনা সরকার এটা বুঝে ফেলে অল্প দিনেই। বাংলাদেশের ফেইসবুক বিরোধী মোল্লাদের দৌড় ও স্ট্যামিনা অল্পই, রাস্তাঘাটে বাদ-জুমা মিছিল করে ফেইসবুকের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েই তারা খালাশ, বড়জোর সরকারকে চাপ দিয়ে কয়েকদিন লোক হাসানো ফেইসবুক ব্যান করাতে পারে, কিন্তু তার পর এই প্রজেক্টে ক্ষান্ত দেবে তারা, এ মোটামুটি জানা কথা। কিন্তু চীনা সরকারের একেবারে গোড়ায় কুঠারাঘাত করতে পারে বিরোধী মতাদর্শ। তাই ইন্টারনেট সেন্সরশীপে চীনারা নিয়োগ করেছে অত্যাধুনিকতম সব প্রযুক্তি।

বাংলাদেশের গেইটওয়ে ব্যানের মতো যেসব ব্যান-প্রযুক্তি মামুলি কৌশলে এড়ানো চলে, তা তো আছেই, তার পাশাপাশি চীনা সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে একটি রাষ্ট্রীয় ইন্টারনেট সেন্সরশীপ ব্যবস্থা। এ নিয়ে চীনের বাইরের ইন্টারনেট প্রযুক্তিবিদদের আগ্রহের কমতি নেই, চীনের এই সেন্সর পদ্ধতির ডাকনাম দেয়া হয়েছে, দ্য গ্রেট ইন্টারনেট ফায়ারওয়াল (অর্থাৎ চীনের মহা-ইন্টারনেট-প্রাচীর)। প্রায় ৩০ হাজার সরকারী পুলিশ নিযুক্ত আছে এই প্রজেক্টে। সরকারীভাবে গোল্ডেন শিল্ড নামে পরিচিত এই প্রজেক্টে যেসব কৌশল খাটানো হয়, তার মধ্যে রয়েছে, আইপি ব্যান করা, ডমেইন নেইম ফিল্টারিং, ইউআরএল ফিল্টারিং, কিংবা প্যাকেট ফিল্টারিং। চীনের এই মহাতথ্যপ্রাচীর বিস্তৃত রয়েছে তাদের সারা দেশ জুড়েই।

খড়গহস্ত সরকারের এই তথ্য দমনের বিরুদ্ধে আশার আলো কি নেই? অবশ্যই আছে, ইন্টারনেটের প্রযুক্তিবিদেরা তথ্যের মুক্তিতে শুরু থেকেই বিশ্বাসী। তাই তথ্যখেকো সরকারদের এসব অত্যাচার এড়াতে তৈরী হয়েছে নানা কৌশল। কম্পিউটার নিরাপত্তার উপরে গবেষণার কারণে এহেন নানা পদ্ধতির কথা বিস্তারিতভাবে জেনেছি অনেকদিন ধরেই ... এগুলোর উপরে দুটি নামজাদা কনফারেন্স রয়েছে, সেখানে প্রতিবছর বিজ্ঞানীরা সেন্সরশীপ এড়াবার বিভিন্ন কৌশল উপস্থাপন করে চলেছেন।

সেন্সরশীপ এড়াবার নানা কৌশলের
মধ্যে রয়েছে,


* আইপি ব্যান প্রতিরোধ (প্রক্সি সার্ভার দিয়ে এটা এড়ানো যায়),

* ডমেইন নেইম ব্যান প্রতিরোধ (সরাসরি আইপি লিখে এড়ানো যায়),

* ইউআরএল ফিল্টারিং (ওয়েব লিংক যাচাই করে নিষিদ্ধ শব্দ পেলে ব্যান করা, ভিপিএন বা এসএসএল দিয়ে এড়ানো যায়),

* প্যাকেট ফিল্টারিং (ওয়েবপেইজ সহ বিভিন্ন ডেটা প্যাকেটের ভেতরে উঁকি দেয়া, আর নিষিদ্ধ কোনো শব্দ পেলেই ঘ্যাঁচাং করে ফেলা, এড়াবার কৌশল হলো এনক্রিপশন বা তথ্যগুপ্তিকরণ)।

* অনিয়ন রাউটিং, মানে অনেকটা ভুত থেকে ভুতে পদ্ধতি। সরাসরি ফেইসবুকে যেতে সরকার বাধা দিলে তার বদলে নির্দোষ কোনো ঠিকানায় রিকোয়েস্ট পাঠানো, সেখান থেকে যাবে পরের ধাপে, এভাবে কয়েক ধাপ পেরিয়ে ফেইসবুকে যাওয়া, আর ফেরার পথে একই ভাবে সোজাপথে (যা ব্যান করা আছে) না গিয়ে ঘুর পথে ফেইসবুকের পাতাটি নিয়ে আসা, এই পদ্ধতিই হলো অনিয়ন রাউটিং (পেঁয়াজের মতোই কয়েক স্তর পেরিয়ে যাওয়া আর কি... )। আর এর সফল সফটওয়ার হলো টর। এটা ছাড়াও আল্ট্রাসার্ফ, ফ্রিগেট সহ নানা ওপেন প্রক্সি ব্যবহারকারী সফটওয়ার দিয়েও এসব বাধা এড়ানো সম্ভব হয়েছে।

----

তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে তথ্যখেকো সরকারদের চলছে বড়োই দুর্দিন। আগে পুলিশী হুমকি বা ব্যানের ভয়ে ছাপাখানা বন্ধ করে দেয়া চলতো, কিন্তু আজ ইন্টারনেটের আমলে কোনো ওয়েবসাইটকে পুরোপুরি ব্যান করে দেয়া রীতিমতো অসম্ভব। খোদ ক্ষমতাশালী চীন সরকারও ব্যর্থ, সেখানে অন্যদের কথা বলাই বাহুল্য। ইন্টারনেট যদি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া না হয়, তবে এসব সাইট ব্যানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোটা আজ ছেলেখেলায় পরিণত হয়েছে। তথ্য দমনের যে হাজার বছরের ঐতিহ্য ধর্মগুরু বা রাজনৈতিক ক্ষমতাধরেরা বজায় রেখেছিলো, ইন্টারনেটের মুক্তিকামী তারুণ্য সেই মহাপ্রাচীরে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে, আর নিত্য নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে ভেঙে চলেছে নিপীড়নের সেই অচলায়তন।

টেক-মুর্খতার অবসান হোক।


লিংক

গণচীনের মহা তথ্য প্রাচীর এড়ানোর নানা কৌশল।