Tuesday, June 1, 2010

নামের বাহার, বাহারী নাম, ফরমুলাতে, ফেলেছি ঘাম (২)

(আগের পর্বের পর) স্কুলের ইতিহাস বইতে মোগল/পাঠান আমলের বিরক্তিকর ইতিহাস গিলতে হয়েছিলো, তাতে একটা ব্যাপার প্রায়ই দেখতাম, অমুকে তমুক জায়গার সিংহাসন দখল করে সুলতান হওয়ার পরে সমুক নাম ধারণ করেছেন।

সেই ধাঁচেই আজ থেকে আমি “জোজো মানু” নামটি ধারণ করলাম।

ঘাবড়ে গেলেন? নাহ, এটা আমার আকীকা দেয়া নাম নয়, কিংবা মায়ানগরের সিংহাসনেও চড়ে বসিনি, বরং এটা আমার আফ্রিকীয় নাম। আরো খোলাসা করে বলতে গেলে, এটা আমার ঘানার আকান গোত্রপদ্ধতির নাম।

ঘানার আকান জাতির এই নামের রীতি পশ্চিম আফ্রিকার অনেক দেশেই চালু আছে। এই পদ্ধতির চমৎকার দিকটা হলো, নাম রাখা নিয়ে কোনো ঝামেলা টামেলা নেই, “শিশুর সুন্দর নাম” জাতীয় বই, কিংবা দাদা-নানার চাপে পড়ে তুঘলকী আমলের নাম রাখারও ফ্যাকড়া নেই। পুরো নামটা চমৎকার এক ফরমুলাতে পড়ে।

দেখা যাক, ফরমুলাটা কী রকম।আকানদের নিয়ম অনুসারে নাম হবে দুই অংশের – প্রথম অংশটি হবে সপ্তাহের কোন বারে জন্ম হয়েছে, সেই বারের নাম। আর দ্বিতীয় অংশে থাকবে বাবা-মার কতো নম্বর সন্তান, সেটা।

ঘানার কফি আন্নান এর কথা নিশ্চয় মনে আছে সবার? ভদ্রলোকের নাম কফি আন্নান কেনো হলো, তা জানতে হলে ঘানার এই জাতিগোষ্ঠীর নামের কায়দাটা বুঝতে হবে। কফি মানে হলো শুক্রবার, আর আন্নান মানে চার নম্বর। সব মিলে বোঝা যায়, জাতিসংঘের এই সাবেক মহাসচিব ছিলেন বাবা-মার চার নম্বর ছেলে সন্তান, যার জন্ম শুক্রবারে।
কফি যদি মেয়ে হতেন, তাহলে তাঁর প্রথম নামটি হতো আফিয়া। দিনভিত্ত্বিক নামের তালিকাটি নিচে দিয়ে দিলাম, এই সিস্টেমে সহজেই নিজের আফ্রিকীয় নামটি বানিয়ে নিতে পারেন।

(বার) -- (ছেলের নাম) -- (মেয়ের নাম)

সোমবার – কোয়াদ্দো বা কোজো বা জোজো - আদজোয়া
মঙ্গলবার – কোয়াবেনা / কোবি – আবিনা
বুধবার – কোয়াকু/কোকু – আকুয়া/আকুবা
বৃহস্পতিবার – ইয়াউ/ইয়াবা/ বাবা/আবা – ইয়ায়া
শুক্রবার – কফি – আফিয়া
শনিবার – কোয়ামে – আম্মা / আমা
রবিবার – আকওয়াসি/ কোয়েসি/ সিসি – আকোসুয়া

আর ক্রমবাচক নামের পদ্ধতি হলো
১ম সন্তান – পিয়েসি বা বার্কো/অর্কো,
২য় সন্তান – মানু বা মাআনু
৩য় সন্তান – মেনসা বা মানসা
৪র্থ সন্তান – আনান বা আন্নান
৫ম সন্তান – নুম বা আনুম
৬ষ্ঠ সন্তান – নসিয়া বা এসিয়েন
৭ম সন্তান – আসোন বা নসোয়া
৮ম সন্তান – বতওয়ে
৯ম সন্তান – আক্রোন বা নক্রুমা
১০ম সন্তান – বদু বা বদুয়া
১১শ সন্তান – দুকু
১২শ সন্তান – দুনু
সবচেয়ে ছোট সন্তান - কাকিয়ে

আবার কী অবস্থাতে জন্ম সেটাও অনেক সময় নামের অংশ হতে পারে, যেমন মাঠে ঘাটে জন্ম হলে আফুম, যুদ্ধাবস্থায় জন্ম হলে বেকু, এরকম।

এবার বলুন তো, কোয়ামে নক্রুমা কী বারে জন্মেছিলেন, আর কত নম্বর সন্তান?

ছক তো দিয়েই দিলাম, এবার চটপট নিজের আফ্রিকীয় নামটি বের করে নিন।

-----------------------

এবার আফ্রিকা থেকে চলে আসি আমাদের পড়শী বার্মার দিকে। নামের দিক থেকে বর্মীদের মতো স্বাধীনতা আর কেউ পেয়েছে কি না সন্দেহ। বর্মী নামের কোনো সিস্টেমই নেই। এমনকি জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম ধারণ করাটাও সেখানে স্বাভাবিক। আর নাম পাল্টাতে হলে সরকারী খাতায় অফিসে দৌড়াদৌড়িরও দরকার নেই।

আর নাম? বর্মীদের অনেকেরই নাম আগে ছিলো এক syllable বিশিষ্ট। হুমায়ুন আহমেদের বইতে বোধহয় পড়েছিলাম, কারো বাচ্চার নাম “নু” রাখা নিয়ে রসিকতা। বর্মীদের কিন্তু এরকম নাম রাখারই চল ছিলো শখানেক বছর আগেও। বিংশ শতকে এসেই কেবল তারা দুইধ্বনির নাম রাখা শুরু করে। কিন্তু তার মধ্যেও অনেক অংশ আসলে “চাচা”, “আংকেল” এই ধরণের। উদাহরণ দেই, বার্মার প্রথম প্রধানম্পন্ত্রীর নাম ছিলো “উ নু” (U Nu), তাঁর নামের প্রথম অংশ উ আসলে বোঝায় “জনাব” বা “মিস্টার” (অথবা সম্মানার্থে আমরা যেমন বলি “চাচা”, সেরকম)। তাঁর আসল নামটি হলো কেবলই “নু”।

আগের উদাহরণের কফি আনানের মতোই জাতিসংঘের আরেক মহাসচিব ছিলেন বর্মী কূটনীতিক উ থান্ট। যথারীতি, তাঁর নামেরও উ অংশটি হলো জনাব, আর থান্ট হলো তার আসল নাম।

অনেক সুপরিচিত বর্মীরই নামের অধিকাংশ অংশ এরকম জনাব বা “চাচা” বা “আন্টি” এরকম বোঝায়। যেমন, মহিলাদের নামে ব্যবহৃত “দ” (Daw) এর অর্থ হলো “বেগম”। মং হলো ছোটভাই। সায়াদও হলো পণ্ডিত, বোগইয়োক মানে সেনাপতি। মিন মানে রাজা।

সুপরিচিত বর্মী রাজনীতিবিদ অং সান সু কীর নামের ব্যাপারটা অনেকাংশে আধুনিক নামকরণ রীতির উদাহরণ। গত বেশ অনেকদিন ধরেই চল শুরু হয়েছে বার্মায়, বাবা মার নাম নামের পেছনে যোগ করে দেয়া। সু কীর নামের প্রথম অংশ “অং সান” আসলে সু কীর জন্মের সময়ে তাঁর বাবার যে নাম ছিলো, সেটাই। সু হলো তাঁর দাদীর নাম। আর কী হলো তাঁর মায়ের নাম।

সুকীর বাবা অং সানের নাম জীবনের শেষদিকে এসে হয়ে যায় বোগইয়োক অং সান, কারণ ততদিনে তিনি সেনাপতি হয়ে গিয়েছিলেন। অং সানের বাবার নাম ছিলো উ ফা (মানে জনাব ফা), আর মায়ের নাম ছিলো দ সু, নামে বেগম সু।

---------------

বর্মী নামের প্যাঁচে পড়ে মাথা ঘুরতে শুরু করেছে? তাহলে চলুন ঘুরে আসি কোরীয় উপদ্বীপ থেকে।

কোরিয়ার কারো সাথে যদি পরিচয় থাকে , তাহলে প্রায় অবধারিত ভাবে বলতে পারি,তার পদবীটি হবে কিম, লী, পার্ক, চো/কো, কিংবা চ্যান (বা চ্যাং, ঝ্যাং)। কোরীয়দের পদবীর ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য একেবারেই নেই। কোরিয়ার পদবীর পরিসংখ্যানটা দেখুন, ২২% লোকের পদবী কিম, ১৪% এর লী, ৮.৫% হলো পার্ক, আর ৪% করে কো/চো এবং চ্যাং/ঝ্যাং। কোরিয়ায় মোট পদবীর সংখ্যা ২৫০টি হলেও পার্ক/লী/কিম এরা মিলে দখল করে রেখেছে ৪৫% । তাই ঠাট্টা করে বলা হয়, কোরিয়ার কোনো রাস্তাতে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে একটা ঢিল ছুড়লে সেটা মিস্টার পার্ক, মিস্টার কিম বা মিস্টার লী’র গায়ে গিয়ে লাগবেই।

গুজব চালু আছে, কোরীয়দের মধ্যে নাকি ছেলে মেয়ের পদবী এক হলে বিয়ে করা মানা।আসলে ব্যাপারটা ওরকম ভয়াবহ না, কোরিয়ার রীতি অনুযায়ী প্রতি পরিবারের পদবী ছাড়াও “বন” বলে গোত্রসূচক আরেকটা নাম আছে। বিয়ের নিয়ম হলো, বন আর পদবী এক হলে বিয়ে করা মানা। একই পরিবার বা গোত্রের মধ্যে বিয়ে এড়াতে এই রীতি চালু করা হয়েছে।

কোরীয়দের নামের আরেকটা ব্যাপার হলো প্রজন্ম নাম। মানে একই পরিবারের ভাই বোন বা চাচাতো ভাইবোনদের নামের মাঝের অংশটি এক হবে, আর সেটা হলো সেই প্রজন্মের নাম।

সব মিলে কোরীয়দের নামের ফরমুলা হলো : পদবী, প্রজন্মনাম, ব্যক্তিগত নাম

অবশ্য অনেক সময়ে ব্যক্তিগত নামটা মাঝেও বসতে পারে।

যেমন, কোরীয়ার বর্তমান নেতার নাম কিম জং ইল। এখানে কিম হলো পদবী, জং হলো তাঁর ব্যক্তিগত নাম, আর “ইল” হলো প্রজন্মের নাম। নেতার ভাইয়ের নাম কিম পিয়ং ইল। আর নেতার তিন সন্তানের নাম হলো কিম জং নাম, কিম জং চুল, আর কিম জং আন । মানে এই প্রজন্মের নাম হয়েছে জং।

(চলবে)

(বাংলাদেশীদের নামের ফরমুলার প্রজেক্টের কথা মাথায় আছে। পরে এক সময় দেয়া হবে, আপাতত চা খেতে গেলাম বলে লেখার সময় পেলাম না, আর ব্লগের মলাটে জায়গা এতো কম , ফরমুলাটা পুরো লিখতেও পারছি না, নইলে দেখিয়ে দিয়েই ছাড়তাম ... )

(তথ্যসূত্র ও ছবি - উইকিপিডিয়া)

1 comment:

Unknown said...

এই পোষ্ট টা অনেক ভালো লাগলো। এখানে অনেক সুন্দর সুন্দর নাম আছে। যা আমার অনেক ভালো লাগলো। এমন সুন্দর নাম দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। হাতে সময় থাকলে আমার এই bd jobs সাইট টা ভিজিট করতে পারেন।
www.bd-career.com