Tuesday, June 1, 2010

ব্যানের রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়

ইতিহাসের আদিলগ্নে যখন থেকে মানুষ লিখতে শিখলো, তখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে তথ্যগোপনের যুগ। শাসক গোষ্ঠী, কিংবা ধর্মগুরুদের হাতে অপছন্দের বা বিপরীত রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতাদর্শের তথ্য নিপীড়িত হয়েছে, বাধা দেয়া হয়েছে তথ্যের অবাধ বিস্তারে।

সেন্সরশীপের রীতিমত প্রাতিষ্ঠানিক রূপটি দিয়েছিলো রোমান সভ্যতা। ৪৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে স্থাপিত হয় সরকারী সেন্সরশীপ দপ্তর, যার কাজ ছিলো ক্ষমতাশালীদের বিরুদ্ধে যায়, এমন সব তথ্য, জ্ঞান বা মতবাদের উপরে খড়গহস্ত হওয়া। সেসময়ের অন্য সভ্যতাগুলোও তৎপর হয়ে ওঠে সেন্সরশীপে, গণতন্ত্রের জন্মভূমি গ্রিসেও চালু হয় বিরোধীপক্ষীয় মতবাদ ব্যান করার প্রয়াস। এই গ্রিক সেন্সরের হাতে বলি হতে হয় দার্শনিক সক্রেটিসকে, ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সক্রেটিসের মতবাদকে সেন্সর করা হয় হেমলক বিষের মরণকামড়ে।

প্রাতিষ্ঠানিক সেন্সরশীপ কঠোরতর হয় রোমান ক্যাথলিক চার্চের হাতে। অখ্রিস্টান, কিংবা খ্রিস্টধর্মের অন্যান্য শাখার, বা বিজ্ঞানের বিভিন্ন মতবাদ, অথবা বইপত্র গণহারে নিষিদ্ধ হতে থাকে চার্চের হাতে। ১৫৫৯ সালে পোপ চতুর্থ পল নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকা প্রকাশ করেন। সভ্যতা এগিয়ে গেলেও বইপত্র সেন্সর করা কিন্তু থামেনি, নিষিদ্ধ বইয়ের এই তালিকাটি প্রকাশ পেয়ে চলেছিলো বিংশ শতকেও, মাত্র ১৯৬৬ সালে এই তালিকাটি ভ্যাটিকান প্রত্যাহার করে নেয়।

রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন মতামত/তথ্য সেন্সর করার রীতি সব স্বৈরাচারী সরকারই চালু রেখেছে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে। নাৎসি জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শুরু করে হালের বার্মা কিংবা গণচীনের সরকার চেষ্টা করে চলেছে জনগণকে তথ্যবঞ্চিত করে রাখার, দ্বার বন্ধ করে তথ্যকে রোখার। ছাপা বইপত্রের আমলে এটা করা ছিলো বেশ সহজ। সরকারই যেখানে ছাপাখানাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম, সেখানে গোপনে ছাপা বা হাতে লেখা ছাড়া অন্য সব কিছুকে দমন করা চলে সহজেই।

দমন-পীড়ণে পারঙ্গম এই তথ্য-খেকো সরকারগুলোর সমস্যা করে দেয় ইন্টারনেট। নব্বইয়ের দশকে গবেষণাগার থেকে আম-জনতার কাছে ছড়িয়ে যাওয়া এই ইন্টারনেটে তথ্য বিস্তার পেয়ে চলে দুর্দম গতিতে; দেশ স্থান কাল নির্বিশেষে তথ্যের অবাধ চলাচল শুরু হয়ে যায় সারা বিশ্বে। ইন্টারনেটের এই সর্বব্যাপ্ত রূপটির কারণে তথ্য সেন্সর করা হয়ে যায় রীতিমত অসম্ভব। আগে যেখানে দেশের ভেতরের বিরোধীমতবাদের কর্মীটিকে পুলিশী হয়রানী কিংবা নির্যাতন করে চাপা দেয়া যেতো তার কণ্ঠকে, সেখানে ইন্টারনেট দেশের সীমার বাইরে ছড়িয়ে দেয় সেই তথ্যের বিস্তার। দেশের জেলে-রিমান্ডে কাউকে পুরে তথ্য চাপা দেয়া চলে, কিন্তু ইন্টারনেটের আমলে হয়তো সেই তথ্যটি রয়েছে দুনিয়ার অপর প্রান্তের কোনো সাইটে, যেখানে তথ্যখেকো সরকারের দলবলের প্রভাব নেই।

তাই ইন্টারনেট সমস্যা করে দেয় গণচীন, ইরান, বার্মা, কিংবা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোর। চীনে গণতন্ত্রকামী তরুণদের অভাব নেই, তারা চায় তাদের দেশের বর্তমান ব্যবস্থার সমস্যাগুলোর সমাধান। ইন্টারনেটের এই সর্বব্যাপ্ত তথ্য জোয়ার ঠেকাতে শুরুতে অনেক কায়দা কৌশল খাটানোর প্রয়াস চলে। বাংলাদেশের ফেইসবুক বা ইউটিউব ব্যানের মতো অতি সাধারণ কৌশল, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকা ইন্টারনেট গেইটওয়েতে ব্যান করে দেয়া হয় বিভিন্ন সাইট। কিন্তু এসব কৌশল খুব সহজেই এড়ানো যায়, প্রক্সি সার্ভার দিয়ে এসব বাধা এড়ানোটা রীতিমত ডাল-ভাত।

চীনা সরকার এটা বুঝে ফেলে অল্প দিনেই। বাংলাদেশের ফেইসবুক বিরোধী মোল্লাদের দৌড় ও স্ট্যামিনা অল্পই, রাস্তাঘাটে বাদ-জুমা মিছিল করে ফেইসবুকের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েই তারা খালাশ, বড়জোর সরকারকে চাপ দিয়ে কয়েকদিন লোক হাসানো ফেইসবুক ব্যান করাতে পারে, কিন্তু তার পর এই প্রজেক্টে ক্ষান্ত দেবে তারা, এ মোটামুটি জানা কথা। কিন্তু চীনা সরকারের একেবারে গোড়ায় কুঠারাঘাত করতে পারে বিরোধী মতাদর্শ। তাই ইন্টারনেট সেন্সরশীপে চীনারা নিয়োগ করেছে অত্যাধুনিকতম সব প্রযুক্তি।

বাংলাদেশের গেইটওয়ে ব্যানের মতো যেসব ব্যান-প্রযুক্তি মামুলি কৌশলে এড়ানো চলে, তা তো আছেই, তার পাশাপাশি চীনা সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে একটি রাষ্ট্রীয় ইন্টারনেট সেন্সরশীপ ব্যবস্থা। এ নিয়ে চীনের বাইরের ইন্টারনেট প্রযুক্তিবিদদের আগ্রহের কমতি নেই, চীনের এই সেন্সর পদ্ধতির ডাকনাম দেয়া হয়েছে, দ্য গ্রেট ইন্টারনেট ফায়ারওয়াল (অর্থাৎ চীনের মহা-ইন্টারনেট-প্রাচীর)। প্রায় ৩০ হাজার সরকারী পুলিশ নিযুক্ত আছে এই প্রজেক্টে। সরকারীভাবে গোল্ডেন শিল্ড নামে পরিচিত এই প্রজেক্টে যেসব কৌশল খাটানো হয়, তার মধ্যে রয়েছে, আইপি ব্যান করা, ডমেইন নেইম ফিল্টারিং, ইউআরএল ফিল্টারিং, কিংবা প্যাকেট ফিল্টারিং। চীনের এই মহাতথ্যপ্রাচীর বিস্তৃত রয়েছে তাদের সারা দেশ জুড়েই।

খড়গহস্ত সরকারের এই তথ্য দমনের বিরুদ্ধে আশার আলো কি নেই? অবশ্যই আছে, ইন্টারনেটের প্রযুক্তিবিদেরা তথ্যের মুক্তিতে শুরু থেকেই বিশ্বাসী। তাই তথ্যখেকো সরকারদের এসব অত্যাচার এড়াতে তৈরী হয়েছে নানা কৌশল। কম্পিউটার নিরাপত্তার উপরে গবেষণার কারণে এহেন নানা পদ্ধতির কথা বিস্তারিতভাবে জেনেছি অনেকদিন ধরেই ... এগুলোর উপরে দুটি নামজাদা কনফারেন্স রয়েছে, সেখানে প্রতিবছর বিজ্ঞানীরা সেন্সরশীপ এড়াবার বিভিন্ন কৌশল উপস্থাপন করে চলেছেন।

সেন্সরশীপ এড়াবার নানা কৌশলের
মধ্যে রয়েছে,


* আইপি ব্যান প্রতিরোধ (প্রক্সি সার্ভার দিয়ে এটা এড়ানো যায়),

* ডমেইন নেইম ব্যান প্রতিরোধ (সরাসরি আইপি লিখে এড়ানো যায়),

* ইউআরএল ফিল্টারিং (ওয়েব লিংক যাচাই করে নিষিদ্ধ শব্দ পেলে ব্যান করা, ভিপিএন বা এসএসএল দিয়ে এড়ানো যায়),

* প্যাকেট ফিল্টারিং (ওয়েবপেইজ সহ বিভিন্ন ডেটা প্যাকেটের ভেতরে উঁকি দেয়া, আর নিষিদ্ধ কোনো শব্দ পেলেই ঘ্যাঁচাং করে ফেলা, এড়াবার কৌশল হলো এনক্রিপশন বা তথ্যগুপ্তিকরণ)।

* অনিয়ন রাউটিং, মানে অনেকটা ভুত থেকে ভুতে পদ্ধতি। সরাসরি ফেইসবুকে যেতে সরকার বাধা দিলে তার বদলে নির্দোষ কোনো ঠিকানায় রিকোয়েস্ট পাঠানো, সেখান থেকে যাবে পরের ধাপে, এভাবে কয়েক ধাপ পেরিয়ে ফেইসবুকে যাওয়া, আর ফেরার পথে একই ভাবে সোজাপথে (যা ব্যান করা আছে) না গিয়ে ঘুর পথে ফেইসবুকের পাতাটি নিয়ে আসা, এই পদ্ধতিই হলো অনিয়ন রাউটিং (পেঁয়াজের মতোই কয়েক স্তর পেরিয়ে যাওয়া আর কি... )। আর এর সফল সফটওয়ার হলো টর। এটা ছাড়াও আল্ট্রাসার্ফ, ফ্রিগেট সহ নানা ওপেন প্রক্সি ব্যবহারকারী সফটওয়ার দিয়েও এসব বাধা এড়ানো সম্ভব হয়েছে।

----

তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে তথ্যখেকো সরকারদের চলছে বড়োই দুর্দিন। আগে পুলিশী হুমকি বা ব্যানের ভয়ে ছাপাখানা বন্ধ করে দেয়া চলতো, কিন্তু আজ ইন্টারনেটের আমলে কোনো ওয়েবসাইটকে পুরোপুরি ব্যান করে দেয়া রীতিমতো অসম্ভব। খোদ ক্ষমতাশালী চীন সরকারও ব্যর্থ, সেখানে অন্যদের কথা বলাই বাহুল্য। ইন্টারনেট যদি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া না হয়, তবে এসব সাইট ব্যানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোটা আজ ছেলেখেলায় পরিণত হয়েছে। তথ্য দমনের যে হাজার বছরের ঐতিহ্য ধর্মগুরু বা রাজনৈতিক ক্ষমতাধরেরা বজায় রেখেছিলো, ইন্টারনেটের মুক্তিকামী তারুণ্য সেই মহাপ্রাচীরে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে, আর নিত্য নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে ভেঙে চলেছে নিপীড়নের সেই অচলায়তন।

টেক-মুর্খতার অবসান হোক।


লিংক

গণচীনের মহা তথ্য প্রাচীর এড়ানোর নানা কৌশল।

1 comment:

Unknown said...

"ব্যানের রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়"
এই কমেন্টটিও ব্যান হওয়ার মত ।
Tenders And Consulting Opportunities in
Bangladesh