Wednesday, November 19, 2008

নমস্য ইউজার - গুগল, ইয়াহু!, আর আন্তর্জালের দূরদর্শিতা

বিশ্বব্যাপী জনসাধারনের আয়ত্বে ইন্টারনেটের আগমন যখন ঘটে ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে, তখন থেকেই দিনে দিনে ওয়েবসাইট নির্মান সহজ থেকে সহজতর হয়ে উঠেছে। এর সাথে সাথে তৈরী হয়েছে নানা বিজনেস মডেল বা ব্যবসায়িক কৌশলের।

সফটওয়ার কোম্পানিগুলো আগে ব্যবসা করতো সফটওয়ারকে পণ্যের মতো কেনা বেচা করে। কিন্তু ইন্টারনেট আসার সাথে সাথে নতুন কৌশল আসে - ওয়েবসাইটভিত্তিক সার্ভিস। ব্রাউজারের মাধ্যমে ওয়েবমেইল, মেসেঞ্জারের মাধ্যমে চ্যাট - এসবের পাশাপাশি হালে শুরু হয়েছে ওয়ার্ড প্রসেসর, স্প্রেডশীট, প্রেজেন্টেশন - এই সবগুলোকেই ইন্টারনেটে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে হাতের নাগালে এনে দেয়া।

প্রথম দিকে এরকম সেবাদাতা সাইটগুলো নগদ পয়সা ছাড়া সেবা দিতে নারাজ ছিলো। মনে আছে, এক সময়ে ইয়াহু মেইলে ফ্রি দিতো ৬ মেগাবাইট, আর পয়সা দিলে ২০ মেগাবাইট। এর বেশি অল্প গেলেই মেইল বাউন্স শুরু করতো। কোম্পানীগুলো প্রথমে ভেবেছিলো, "ফেলো কড়ি, মাখো তেল" - এই পদ্ধতি ওয়েবদুনিয়াতেও কাজ করবে।

কিন্তু দেখা গেলো, প্রতিযোগিতার এই বিশ্বে প্রতিদ্বন্দ্বীরা বিনা মূল্যে অনেক সার্ভিস দিতে শুরু করেছে। আম-জনতাও বোকা না - সার্ভিস পেতে হলে টাকা দিতে হবে, টাকা না দিলে মুখ বন্ধ করে সার্ভিস দাতা কোম্পানির হম্বি তম্বি স্বৈরাচারী আচরণ সব সইতে হবে - সে যুগ আর নেই। ইয়াহুর পয়সা নেয়া ইমেইলের প্রতিদ্বন্দ্বী সার্ভিস হিসাবে এলো গুগলের জিমেইল, বিনা মূল্যে বিপুল জায়গা দিলো। "দাও টাকা, নইলে ইমেইল মুছে দিলাম", "টাকা দাওনা তো সার্ভিস চাও কেনো" - এরকম মানসিকতার সব সাইট রাতারাতি ধরা খেলো।

২০০০ সালের দিকের ডট কম বিপর্যয়ের পরে এখন সব কোম্পানিই সাবধানী হয়ে গেছে। ইউজারেরাই এখন নমস্য - তাদের খুশি রাখতে পারলেই যে আয় হবে কোনো না কোনো ভাবে, সেটা এখন সবাই বোঝে। তাই এখন খোদ মাইক্রোসফটও অফিস লাইভের মাধ্যমে তাদের অনেক সার্ভিস দিচ্ছে বিনা মূল্যেই।

---

এতো কথা মাথায় আসলো আসলে গত সপ্তাহের এক বক্তৃতা শুনে। ইন্টারনেটে অনেক কিছুরই পথিকৃত ইয়াহু!র একটা রিসার্চ সেন্টারও আছে, সেখানে ওয়েব প্রযুক্তি নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলে। সেই ইয়াহু রিসার্চের প্রধান বিজ্ঞানী প্রভাকর রাঘবন গত সপ্তাহে ইয়াহুর ব্যবসায়িক কৌশলে ব্যবহার করা প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করছিলেন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে। গুগলের মতো ইয়াহুর মূল আয়টি আসে বিজ্ঞাপন থেকে। সার্চ করার সময়ে মূল ফলাফল বামে আসে, আর পাতার একেবারে ডানদিকে কিছু সম্পর্কিত বিজ্ঞাপন দেখা যায়। ১০০ জনে দুই এক জন হয়তো সেখানে ক্লিক করে। তখন বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানি ইয়াহুকে কিছু পয়সা দেয়। অল্প মনে হলেও কোটি কোটি সার্চ দিনে করা হয়, কাজেই মোট হিসাবে পরিমাণটা কম না। বিলিয়ন ডলারের কোঠায় দাঁড়ায় সেটা।

বিজ্ঞাপনগুলো আবার নিলামের মতো, যে কোম্পানী বেশি টাকা দিবে বিজ্ঞাপনে, তাদের বিজ্ঞাপনকেই আগে দেখাবে।

তো, একজন প্রশ্ন করলো ডঃ রাঘবনকে, বিজ্ঞাপনে ক্লিক করাতে যদি পয়সা পাওয়া যায়, তাহলে ইয়াহু! বামদিকের সার্চ রেজাল্টের সাথে বিজ্ঞাপন মেশাচ্ছেনা কেনো? ওখানে সার্চের ফলাফল হিসাবে খোঁজ করা শব্দগুলোর সাথে সম্পর্কিত সাইটের লিংক না দেখিয়ে, যারা টাকা দিচ্ছে বিজ্ঞাপনে, তাদের লিংক দেখালেই তো চলে। ইউজারেরা তো মাগনা মাগনা সার্চ করছে, ওদের পাত্তা দেয়ার দরকার কী? এমনি এমনি ফ্রি রেজাল্ট পাচ্ছে, সেই রেজাল্ট কোম্পানির বিজ্ঞাপন না আসল রেজাল্ট, তা নিয়ে ইউজারেরা কথা বলার অধিকার রাখবে কেনো!! না পোষালে অন্য সাইটে যেতেই পারে। ইয়াহু নিজের যাতে লাভ, তা করলেই পারে।

জবাবে ডঃ রাঘবন বললেন, এই ব্যাপারটা নিয়ে প্রস্তাব আসেনি তা না। কিন্তু ব্যাপারটাকে এভাবে দেখা যাক - ইউজারদের জন্যই তো বিজ্ঞাপনদাতারা বিজ্ঞাপন দেবে। সেই ইউজারেরা যদি সন্তুষ্ট না হয়, তাদের কাংক্ষিত সার্চ ফলাফলের বদলে যদি বিজ্ঞাপন পান, তাহলে ইয়াহু হয়তো আজকে কিছু বিজ্ঞাপনের পয়সা পাবে। কিন্তু এই অতৃপ্ত ও অসন্তুষ্ট ইউজার ইয়াহু দিয়ে আর পরে সার্চ করবে না। ফলে আখেরে ক্ষতিটা হবে ইয়াহুরই ... ইউজারেরা না আসলে বিজ্ঞাপন দাতারাও চলে যাবে।

কাজেই ইয়াহুর (এবং গুগলেরও) নীতি হলো, ইউজারদের নমস্য বলে জ্ঞান করা, তাদের খুশি রাখা। ইউজারদের খুশি রাখলে বিজ্ঞাপন দাতারা সেই ইউজারদের টানেই আসতে থাকবে।

তাই আজকের ওয়েব দুনিয়াতে ইউজাররাই হলো নমস্য - ওয়েবসাইটের প্রাণই হলো ইউজারেরা। বিনা মূল্যে সার্ভিস নিলেও তাদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্যেই ওয়েবসাইটগুলো করে চলে প্রাণপণ চেষ্টা, তা হয়তোবা অনেকটা নিজেদের স্বার্থেই।

Thursday, October 16, 2008

বাকের ভাইয়ের একদিন ...

"কোথাও কেউ নেই" নাটকটি নব্বইয়ের দশকের বাংলাদেশে অর্জন করেছিলো বাঁধভাঙা জনপ্রিয়তা, বাকের ভাইয়ের চরিত্রকে আসাদুজ্জামান নূর এতো চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, সেই অতুলনীয় অভিনয়ের সুবাদে ঘরে ঘরে তখন বাকের ভাইয়ের জয়গান। পাড়ার মাস্তান, কিন্তু ভালো মানুষ বাকের ভাইয়ের বিবেক রয়েছে, সে বিবেক টাকার কাছে বিকিয়ে যায়নি, কপালদোষে মাস্তান হলেও ঠিক কাজটি করতে বাকের ভাই পিছ পা হন না। বাস্তব জীবনে সেরকম মাস্তান দুর্লভ হলেও কল্পনা করতে বাঁধা নেই, তাই বাকের ভাইয়ের ফাঁসীর আদেশ হলে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল বের হয়, ভয়ে হুমায়ুন আহমেদ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যান ক'দিনের জন্য।

নব্বইয়ের দশক শেষ হয়ে আসে, হুমায়ুনের লেখাও ম্লান হয়ে যায়, বাকের ভাইয়ের কথাও জনমানুষের মন থেকে মুছে যায়।

নব্বইয়ের দশকের শেষভাগের এক রোদেলা বিকেলে আমার মাথায় হঠাৎ ভুত চেপে বসে, একটা বেমক্কা আকারের বড়সড় হেডফোন কিনতেই হবে। বুয়েটে সদ্য প্রথম বর্ষে পড়ি, তখন সেটার হিড়িক চলছে, কানঢাকা জাহাজের হেডফোন কানে লাগালে বাইরের সব শব্দ চাপা পড়ে যায়।

পলাশীর মোড় থেকে রিকশা চেপে বন্ধু প্রদীপ্তের সাথে যাই বায়তুল মোকাররম স্টেডিয়াম মার্কেটে তখনো বসুন্দরা সিটির ঝকমকে বাজার খুলতে বহুদিন বাকি। ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতির বাজার বলতে ওটাই। বাজারে অবশ্য ঠকে যাওয়ার বিশাল সম্ভাবনা, বেকুব ক্রেতাদের মাথায় কাঁঠাল ভাঙতে বিক্রেতারা সদা তৎপর। খেয়াল করে জিনিষ না কিনলে দুই তিনগুণ দাম দিতে হবে নির্ঘাত। চোখ কান খোলা রেখে আমরা তাই হাতড়ে বেড়াচ্ছি হেডফোনের সম্ভার। সস্তা চীনা নকল হেডফোনের ভীড়ে খাঁটি জাহাজী মাল পাওয়া দুস্কর, দোকানদার নকল মাল গছাতে সদা সচেষ্ট, তাকে ঝাড়ির উপরে রেখে বিজ্ঞ চেহারা করে দুই বন্ধু সর্দারী করছি। হেডফোন দুই একটা পছন্দ হয়ে যায়, কিন্তু না পরে কিনলে ঠকে যাবো, সেই জন্য পরখ করতে থাকি।

এমন সময়ে ঘটল অভাবনীয় ঘটনা, পছন্দ হওয়া হেডফোনটা মাথায় পরে দেখতে যাওয়া মাত্র ডান পাশটা খুলে এলো অনায়াসে। বেকুব বনে গেলাম, কারণ জিনিষটা আগে থেকেই আলগা ছিলো, টেরই পাইনি।

দোকানী তো ঈদের চাঁদ পেয়ে গেল মুহূর্তেই, সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে রীতিমত ঘিরে ধরলো আমাদের। "মাল ড্যামেজ কইরা ফালাইসেন", "ক্ষতিপূরণ দেন", এহেন হুমকির বন্যা বয়ে গেলো। হেডফোনের দিকে ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম, সুকৌশলে সুপার গ্লু দিয়ে জোড়া লাগানো ছিলো, সেই সুপার গ্লু দিয়ে এটা ঠিক করার প্রস্তাব শুনে দোকানী রীতিমত ডিপজলের মতো অট্টহাসি হাসলো।

বাধ্য হয়ে বললাম, ঠিক আছে, কিনেই নেই, দাম কতো? এতক্ষণ যেসব হেডফোনের দাম চাইছিলো ২০০-৩০০ টাকা, ঝোপ বুঝে কোপ মারার সুযোগে দোকানী এখন চেয়ে বসলো ৮০০ টাকা!! আমার বন্ধুটিও সুবোধ বালক, অবস্থা দেখে ঘাবড়ে মুখ চুন, পকেটে আমাদের কারোরই ৪০০ টাকার বেশি নেই,বহুদিন ধরে পেপারে পড়ে আসা হেডলাইনগুলো ভেসে এলো, দোকানে আটকে রেখে গণপিটুনি দেয়াতে এই মার্কেট আর ঢাকা কলেজের সামনের মার্কেটগুলোর দুর্নাম দীর্ঘদিনের। দোকানীর মতিগতি দেখেও তাই মনে হলো, চ্যালাদের হাত নিশপিশ করছে যেনো আমাদের দুজনকে বাগে পেয়ে।

বুকে একটু সাহস এনে প্রতিবাদ জানালাম, ভাঙা জিনিষ কেনো এই দামে কিনবো ... কিন্তু দোকানী নাছোড়বান্দা, জরিমানা করে ছাড়বেই। আমাদের প্রতিবাদ দেখে দোকানী তার চ্যালাকে আদেশ দিলো, "অই, নুরা ভাইরে ডাক তো"!!

নূরা ভাই কে, জানিনা, কিন্তু বুঝতে বাকি রইলোনা, স্টেডিয়াম মার্কেটের বাঁধা মাস্তান "ভাই" তিনি, বেয়াড়া ক্রেতাদের শায়েস্তা করে "বানাইয়া দেয়া"র কাজটা তিনিই করে থাকেন। বুয়েটে আর আস্ত অবস্থায় ফেরত যাওয়া হবে কি না, চিন্তায় পড়ে গেলাম, দোয়া দরুদের স্টক হাতড়াতে থাকি।

আধা মিনিটেই নুরা ভাই হাজির। টিপিকাল মাস্তান চেহারা, সিনেমার পাতা থেকে উঠে আসা, গলায় সোনালী চেইন, টি শার্ট জিন্স, আর খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গাঁজা খোর লাল চোখে রাগরাগ ভঙ্গীতে আমরা দুই গোবেচারার দিকে তাকালেন, তার পর দোকানীর দিকে চেয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন, "কি হইসে"?

দোকানী বিজয়ের হাসি হেসে বললো, আমরা দুইজনে মিলে হেডফোন ভেঙে ফেলেছি, কাজেই নুরা ভাই যাতে একটু সাইজ করে দেন। আর প্রমাণ হিসাবে ভাঙা হেডফোন তুলে ধরলো নুরা ভাইয়ের কাছে।

আমাদের অবস্থা তখন কেরোসিন, আজ বোধহয় নুরা ভাইয়ের হাতে "বানানো" হতে হবে... এহেনো চরম মুহূর্তে নুরা ভাই হেডফোনটা হাতে তুলে নিলেন, একবার সুপারগ্লু দিয়ে আগে লাগানো-এখন ভাঙা টুকরাটা দেখলেন, তার পর দোকানী আর আমাদের দিকে চাইলেন।

তার পর?

অবাক করে দিয়ে আমাদের দিকে চেয়ে বললেন,"ভাই, আপনারা এখান থেকে চলে যান তো এখনই"!!

আমাদের হতভম্ব চেহারা তো আর দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু দোকানী ততোধিক হতভম্ব নুরা ভাইয়ের কথা শুনে, মিন মিন করে বলতে যাচ্ছিলো হেডফোনের কাহিনী, কিন্তু নুরা ভাইয়ের প্রকান্ড চিৎকারে চুপ মেরে গেলো, ভাঙা হেডফোন নিয়ে গোবেচারা দুজনকে হেনস্তা করার জন্য নুরা ভাই কষে কয়েকটা গালি দিলেন দোকানীকে। তার পর আবারো আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, "ভাই আপনারা চলে যান"!!

মত পাল্টানোর আগেই আমরা আর অপেক্ষা করিনি, এক দৌড়ে পগাড় পার। হেডফোন আর সেদিন কেনা হয়নি, হেডফোন কেনার শখও চলে যায় চিরতরে।

কিন্তু কী দেখে নুরা ভাই মাস্তানীর রোল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, আজো জানা হয়নি। আর মাস্তানদের মধ্যে যে দুই একজন বাকের ভাই থাকে, অন্ধকারের মধ্যে থেকেও ন্যায়নীতি, বিবেক চলে যায় না সবার -- সেই বিশ্বাস পাকা হয়েছিলো সেদিন।

হয়তো মানুষ কখনোই ১০০% খারাপ হয় না। মিলগ্রাম যাই বলুন না কেনো , হয়তো মানুষ সব অবস্থাতেই কিছুটা মনুষ্যত্ব বজায় রাখে।

পৃথিবীটা তাই আজো টিকে আছে ...

(রচনাকাল অক্টোবর ২০০৮)

Monday, June 9, 2008

লাখের বাতি

এক লাখ টাকা মানে কত্তো টাকা?

আমার ছেলেবেলাতে বড়লোক বোঝাতে লক্ষপতিরই চল ছিলো। আশির দশকে এক লাখ টাকায় অনেক কিছু হয়, সরকারী চাকুরের ২০ মাসের বেতন, একটা গাড়ির দামের পুরোটা না হোক, ৮০-৯০%, শহরের এখানে সেখানে বেশ খানিকটা জমি, -- এক লাখ টাকায় সব এসে যেতো হাতের নাগালে। সিনেমার নায়িকার বাবা পাইপ-হাতে ড্রেসিং-গাউন-পরে সিঁড়ি-দিয়ে-নামা চৌধুরী সাহেবরা হতেন সব সময়ে লাখ পতি। লাখ টাকা তাই সেই শৈশবের আমার চোখে ছিলো এক অভাবনীয় সম্পদ।

দিন যায়, টাকার দাম কমতে থাকে। নব্বইয়ের দশকে এসে লাখ টাকার দাম পড়ে যায়, সরকারী চাকুরের ছয় মাস-বছরখানেকের বেতনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু আশির দশকে বড়ো হওয়া আমার প্রজন্মের কাছে লাখ টাকার মোহ রয়ে যায় অপরিবর্তিত।

নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে যখন কারিগর হওয়ার পাঠশালাতে নাম লেখাই, লাখ টাকার মীথ রয়ে গেছে সবার মাঝে। হলবাসী আমরা খেটে খাওয়া, ঢাকাবাসী বাসার ছেলেমেয়েদের মতো টাকার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত না থেকে টিউশনি বা অন্য উপায়ে চলতে হয়, পারলে উলটো বাড়িতে টাকা পাঠানোর ব্যাপার এসে যায়। এহেন সময়েও লাখ টাকার কথা হাতছানি দেয় আমাদের।

হুমায়ুন আহমেদের লেখা উপন্যাস তখনো জনপ্রিয়, সেরকম এক গল্পে পড়েছিলাম আমরা, গ্রামাঞ্চলে লাখ টাকার মালিক হলে "লাখের বাতি" জ্বালাতে হয়। সেই বাতির শিখা দেখে সবাই বোঝে, এখানে রয়েছে এক লাখপতি।

আড্ডায় আড্ডায় আমাদের বন্ধুদের মধ্যে এই কথাটা এসে যায়। আমার এক বন্ধু বেশ গুরুত্বের সাথেই নেয় এটাকে ... জানপ্রাণ পণ করে ঠিক করে, লাখের বাতি জ্বেলেই ছাড়বে। টিউশনি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পন্থায় লেগে থাকে এজন্য। ৫০, ৬০, ৭০ হাজারে পৌছে অবশ্য আর আগায় না। তখন ব্যাটা নিলো নতুন কৌশল ...এক সময় দেখি ওকে সবাই এড়িয়ে চলছে, দূর থেকে দেখলেই গায়েব হয়ে যেতে চায়। ব্যাপারটা কী? কাছে যেতেই পরিষ্কার হলো, ও এখন লাখ টাকা ব্যাংকে বানানোর জন্য ধার করে চলেছে... সেভাবে চলতে চলতে এক সময় লাখের গণ্ডি পেরিয়ে গেলো, আমাদের কাছ থেকে দেখা হাতের নাগালের প্রথম লাখপতি ... বিশাল ছিল দেয়ার চেষ্টা পুরোটা না হলেও কিছুটা সার্থক হলো।

কিন্তু লাখের বাতি? তার কী হবে? পাঠশালার ছাত্রাবাসে কখনোই বিদ্যুৎ যায় না ... (গোপন সূত্রে শুনেছি, বঙ্গভবন আর প্রধানমন্ত্রীর অফিসের পরেই নাকি আমাদের পাঠশালার গুরুত্ব দিয়ে রেখেছে , হয়তোবা আমাদের পাঠশালায় পড়া বৈদ্যুতিক কারিগরেরাই), কাজেই হারিকেন বা অন্য বাতি তো নেইই। কী আর করা, খুঁজে পেতে বের করা হলো একটা LED, (রেডিও টিভিতে মিটমিটে যে লাল আলো দেখেন, সেই আলোর বাতি)। গোটা দুয়েক দেড় ব্যাটারি বের করে সেই LED লাগিয়ে দিলাম আমরা নব্য লাখপতির জানালায়। বারান্দায় রাতের আলো আঁধারে লাখের বাতি দেখতে সবাই এলো ...

হাজার হলেও লাখপতিকে হাতের কাছে পাওয়া তখনো ছিলো অনেকটাই অচিন্ত্য!!

----

পাদটীকা

দলে দলে ছাত্রদের গণকচালনবিদ্যা পড়িয়ে পড়িয়ে আমিও লাখের বাতি জ্বালি মাস খানেক পরে, কিন্তু আমার লাখপতি জীবনের মেয়াদ ছিলো সপ্তাহ খানেক। বাবার হার্টের অপারেশন, আর বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের খরচে এক লহমাতেই লাখপতি আমি নেমে আসি দশ-হাজারীদের দলে।

আর এখন? লাখ টাকার আর মূল্য নেই। আমাদের সবাই এখন লাখপতি ... মাস দুমাসেই লাখটাকা বেতন পায় দেশে পরিচিত অনেকেই। তবু বন্ধুর জানালায় লাখের বাতি জ্বেলে যে আনন্দ পেয়েছিলাম, সেই আনন্দ দেখিনা লাখপতিদের দুচোখে।

হাতি মরলে আজ আর লাখ টাকা হয় না ... লাখ টাকার, লাখপতিদের দিন শেষ।

Saturday, March 22, 2008

স্টেরিওটাইপের কথকতা

স্টেরিওটাইপ শব্দটা মূলত ঋণাত্মক অর্থেই ব্যবহৃত হয় ... কাউকে তার কোনো বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ঢালাও ভাবে কিছু একটা ভাবাই এর অর্থ। কমেডি ঘরাণার মূল কৌশলগুলোর মধ্যে এটি একটা ... ভাঁড় গোছের চরিত্রকে দিয়ে ভাড়ামি করাতে হলে তাকে স্টেরিওটাইপড করে ফেলা যায়, আর যে গোষ্ঠীর মধ্যে ফেলা, তাদের দুর্নাম যেকারণে, তা দেখিয়ে দর্শকদের (যারা আবার ঐ গোত্রে পড়েনা) বিস্তর আমোদ দেয়া চলে।

বাংলা নাটকে এই রকম স্টেরিওটাইপের ছড়াছড়ি। আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যেসব নাটক হতো, তার নাট্যকারেরা উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গ থেকে আসতেন বলে মনে হয় (হয়তোবা আমিও এখানে স্টেরিওটাইপে ফেলছি তাদের)। সেজন্য অধিকাংশ নাটকেই কমিক রিলিফ চরিত্রটি হতো নোয়াখালী বা চট্টগ্রামের, অবোধ্য অমার্জিত শব্দ চয়নে যাদের বিমল আনন্দ। নাটকের ঘটক হবে গোলটুপী পরা, বাম গালে একটা বড় আঁচিল থাকবে, হাতে একটা ছাতা। আদিবাসী কাউকে দেখাতে হলে তার নাম হবে মলুয়া, কথা বলবে “বটেক”, “বাবু”, “হামি” এরকম ভাষাতে। গ্রামবাসী নায়ক নায়িকার মা কথা বলবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রংপুরের ভাষাতে, অথবা নিতান্তই “শুদ্ধ” ভাষাতে। মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রটি হবে হতদরিদ্র, এবং অধুনা-ক্ষমতাধর-পূর্বে রাজাকার মোড়লের হাতে নিগৃহীত। নাটক থেকে সিনেমাতেও আসবে এসব স্টেরিওটাইপ, নায়িকার বড়লোক বাবার নাম হবে অবধারিত ভাবে “চৌধুরী সাহেব”, বাড়ির ভেতরে পরবেন ড্রেসিং গাউন, ধুমপানের পাইপ হাতে সিঁড়ি বেয়ে নামবেন। নায়ক গরীব কিন্তু শিক্ষিত হলে নির্ঘাত হবে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। বাংলা নাট্যকারদের দোষ দেই কীভাবে, স্বয়ং শেক্সপিয়ারের নাটকে স্টেরিওটাইপের ছড়াছড়ি ... ইহুদি শাইলক হয় ভিলেন, চার্লস ডিকেন্সের অলিভার টুইস্টের ঘৃণ্য ভিলেন ফ্যাগিনকেও দেখানো হয়েছে ইহুদি। সেরকম হালের মারদাঙ্গা টাইপের হলিউডী ছবিতে ভিলেনটা হয় আরব মুসলমান।

নাটক-সিনেমা থেকে বাস্তবতার মধ্যেও একই দশা। হিন্দু হলেই ধরে নেয়া হবে, ব্যাটা একটু পরেই সব কিছু পাচার করে দেবে ভারতে, অথবা আওয়ামী লীগের সমর্থক হবে। কারো মাথায় টুপি থাকলে, বা মুঠোখানেক দাড়ি থাকলে সন্দেহ হবে, জামাত-শিবির কি না। চারুকলা কিংবা স্থাপত্যের ছাত্রদের হতে হবে লম্বা এলোমেলো চুলের সিগারেট ফোঁকা চেহারা, আর বুয়েটের প্রকৌশলবিদ্যার কারিগরেরা হবে চশমাপরা নিরীহ চেহারার বিশিষ্ট আঁতেল। বুদ্ধিজীবীরা হবে ফতুয়া বা পাঞ্জাবী পরা, কাঁধে শাল। সাফারি সুট কিংবা মুজিব কোটে বেরিয়ে আসবে রাজনৈতিক পরিচয়।

এহেন মানসিকতা অব্যাহত থাকবে দেশের বাইরে এলেও। কৃষ্ণাঙ্গ দেখলেই সন্দেহ হবে, ছিনতাই করবে নির্ঘাত এখনই। (আমার এক বাঙালি বন্ধু এই সমস্যাতে পড়ে প্রায়ই ... হুডতোলা জ্যাকেট পরে ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে সন্ধ্যায় হেঁটে গেলে নাকি উলটো দিক থেকে আসা ছেলে মেয়েরা সবাই ভয় পেয়ে রাস্তা পেরিয়ে অন্য দিকে হাঁটে)।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় বা পাকিস্তানীদের স্টেরিওটাইপ কিছুদিন আগে পর্যন্তও ছিলো মুদী দোকানদার হিসাবে ... ইদানিং অবশ্য গাদায় গাদায় দক্ষিণ এশীয় প্রকৌশলীদের দেখে সেটা কমেছে। ভিলেনের স্টেরিওটাইপের ব্যাপারটা কালে কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালটে গেছে ... বর্ণবাদের আমলে ভিলেন হতো কৃষ্ণাঙ্গরা ... তাদের “পাশবিকতা” দেখানো হতো, আর শ্বেতাঙ্গ নায়ক অসহায় নায়িকাকে উদ্ধার করতো এই কৃষ্ণাঙ্গ ভিলেনের কবল থেকে। বিংশ শতকের শুরুতে ইতালীয়দের অভিবাসন বেড়ে যায়, আর দরিদ্র ইতালীয় অভিবাসীরা অনেক শ্বেতাঙ্গ মার্কিনীর কাজ আরো কম বেতনে করে হাতিয়ে নেয়। ফলে সে সময়কার গল্প নাটকে সিনেমাতে ভিলেনের স্টেরিওটাইপে এসে পড়ে ইতালীয়রা। ইহুদীবিদ্বেষ অব্যাহত থাকায় ধনী ভিলেন দেখানো হতো এই ধর্মাবলম্বী কাউকে। সত্তরের দশকের শেষ থেকে আশির দশক জুড়ে জাপানি ব্যবসায়ীরা নবলব্ধ বিত্তে কিনতে থাকে আমেরিকার সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এ সময়ের এশীয়-বিরোধী স্টেরিওটাইপিংটাও লক্ষ্যনীয়। গল্প সিনেমাতে এশীয় পুরুষ হলেই হতো গ্যাংস্টার, ধুর্ত ব্যবসায়ী, কিংবা বেকুব গোছের বোকাসোকা দোকানদার – মূল নায়কের সাথে ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বোল বলে হাসির পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই তার কাজ।

অবশ্য স্টেরিওটাইপ নিয়ে মস্করাও কম করা হয় না টিভি/সিনেমাতে। জনপ্রিয় মার্কিন কার্টুন দ্য সিম্পসন্সের সবগুলো চরিত্রই ইচ্ছাকৃতভাবে চরম স্টেরিওটাইপড। ভারতীয় মুদী-দোকানী অপু, কুটকৌশলী ব্যবসায়ী মিস্টার বার্ন্স, হোমার সিম্পসন নিজেই – সবই বিভিন্ন স্টেরিওটাইপ, আর ইচ্ছা করেই তাদের বিভিন্ন আচরণ দেখিয়ে স্টেরিওটাইপিংকেই মস্করা করা হয়। একই ব্যাপার দেখি আরেক জনপ্রিয় কার্টুন “ফ্যামিলি গাই”-তে, সবাই সেখানে স্টেরিওটাইপড, সবার কাজই স্টেরিওটাইপ অনুসারে।

স্টেরিওটাইপিং নিয়ে যতই আলোচনা করা হোক না কেনো, হয়তো এটা থেকে বেরুনো সম্ভব না আমাদের কারো পক্ষেই। অনেক চিন্তা করে যা মনে হয়, এটা মানুষের অবচেতনে প্রোথিত একটা ব্যাপার – সেই আদিম কালে মানুষ যখন প্রকৃতি আর অন্য প্রাণীদের সাথে সংগ্রামে ব্যস্ত, তখন তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হতো এক মুহুর্তেই যে, সামনে যা এসেছে তা শত্রু না মিত্র। আর সেই ক্ষণিক-সিদ্ধান্ত নিতে হলে চেহারা দেখে আন্দাজ করাটাই একমাত্র কৌশল ... আচরণ-বিচার করার সময় কোথায়।

পূর্বপুরুষদের সেই প্রবৃত্তি আজও হয়তো রয়েছে আমাদের মনের গহীনে, তাই দেখামাত্র কাউকে ফেলে দেই স্টেরিওটাইপে, লেবেল লাগিয়ে দেই ইচ্ছে মতো। হয়তো এই প্রবৃত্তির কবল থেকে মুক্তি নেই আমাদের, যতোই চেষ্টা কসরত করি না কেনো।

হয়তোবা এ আমাদের মানবিক সীমাবদ্ধতা।

Tuesday, March 18, 2008

২০০১ কিংবা ২০০৮/ অডিসির স্বপ্নদ্রষ্টার প্রস্থান


"The truth, as always, will be far stranger."



আর্থার সি ক্লার্কের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে সেই স্কুলে থাকার সময়ে। সেবা প্রকাশনীর কল্যাণে ঝরঝরে অনুবাদে "সন্ধানী" বইটা পড়েছিলাম, লাগামহীন কল্পনার জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম মুহুর্তেই। অনেক পরে আসল বইটা, আর্থার সি ক্লার্কের "২০০১ - এ স্পেস অডিসি" পড়ি, দেখি স্ট্যানলি কুব্রিকের হাতে তৈরী সিনেমাটিও। কিন্তু সন্ধানী আমাকে হঠাৎ করে বানিয়ে দেয় সাইন্স ফিকশনের চরম ভক্ত। ক্লাস নাইনে থাকার সময়ে পাড়ার এক ভাইয়ের কাছে ২০১0 - অডিসি ২ পেয়ে যাই, গোগ্রাসে গিলি পরের গল্পকথা। লালদিঘির পাশের ব্রিটিশ কাউন্সিলে আমার বড়বোনের কার্ড দেখিয়ে সিরিজের বাকি বইগুলোও একে একে পড়া হয়ে যায়।

আর্থার সি ক্লার্কের জন্ম ইংল্যান্ডের সমারসেটে, ১৯১৭ সালে। অভাবের তাড়নায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেননি শুরুতে, শিক্ষাবিভাগে অডিটরের চাকুরি নেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে রয়াল এয়ারফোর্সে রেডার বিশেষজ্ঞ হিসাবে কাজ করেন। যুদ্ধ শেষে লন্ডনের খ্যাতনামা কিংস কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যা ও গণিতে প্রথম শ্রেণীর ডিগ্রি পান।

লেখালেখির শুরু করেন ১৯৪৬ থেকে। ১৯৪৮ সালে লিখেন দি সেন্টিনেল নামের গল্পটি, যা পরে রূপ নেয় ২০০১ - এ স্পেস অডিসি উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে।

এই গল্পটিতেই ক্লার্কের লেখনীর মূল ধারাটির আভাস পাওয়া যায়। পৃথিবীর মানব সভ্যতার সাথে অনেক শক্তিমান ও সুপ্রাচীন অপার্থিব সভ্যতার মোলাকাত ও তার পরিণাম নিয়ে ক্লার্ক লিখেছেন অধিকাংশ উপন্যাস। ক্লার্কের সেই ভবিষ্যত অবশ্য অন্ধকার বা ভীতিকর না, বরং মানবিকতায়, আশাবাদে পরিপূর্ণ সেই অনাগত দিনগুলো।

১৯৫৬ সাল থেকে ক্লার্ক শ্রীলংকাতে বসবাস শুরু করেন। স্কুবা ডাইভিং শখ ছিলো ... সমূদ্রের অমোঘ আহবানে তাই রয়ে যান আজীবন শ্রীলংকার কলম্বোতে।

সাইন্স ফিকশন ছাড়াও ক্লার্কের কল্পনাশক্তির কাছে আমরা, মানে এই ডিজিটাল দুনিয়া প্রচন্ডভাবে ঋণী। বিশ্বাস না হতে পারে, কিন্তু এই ক্লার্কই প্রথম ১৯৪৫ সালে যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবহারের ধারনা দেন। ব্রিটিশ ইন্টারপ্ল্যানেটারি সোসাইটির একটি জার্নালে, এবং পরে ওয়ারলেস ওয়ার্ল্ড নামের সাময়িকিতে ক্লার্ক দেখান, মাত্র তিনটি কৃত্রিম উপগ্রহ দিয়েই সারা বিশ্বের সর্বত্র টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা সম্ভব।

ক্লার্কের ভবিষ্যত-দর্শন এখানেই থেমে থাকেনি। হালের জনপ্রিয় ধারণা, স্পেস এলিভেটর, এটাও জনমানুষের কাছে এসেছে ক্লার্কের উপন্যাস ফাউন্টেইন্স অফ স্পেস-এ। যদিও ধারণাটি নিয়ে আগে কিছু বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী আলোচনা করেছেন, জনপ্রিয় সাহিত্যে এর প্রথম উপস্থাপনা ঘটে এই উপন্যাসে।

কৈশোরে আমার কাছে মহাবিশ্বের দুয়ার খুলে দেয়া সেই আর্থার সি ক্লার্ক আজ মারা গেছেন, শ্রীলংকার কলম্বোতে, ৯১ বছর বয়সে। ক্লার্কের এই মহাপ্রয়াণে নিবেদন করছি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

শেষ করছি ক্লার্কের কিছু বাণী দিয়ে।

  • Perhaps it is better to be un-sane and happy, than sane and un-happy. But it is the best of all to be sane and happy. Whether our descendants can achieve that goal will be the greatest challenge of the future. Indeed, it may well decide whether we have any future.
  • The Information Age offers much to mankind, and I would like to think that we will rise to the challenges it presents. But it is vital to remember that information — in the sense of raw data — is not knowledge, that knowledge is not wisdom, and that wisdom is not foresight. But information is the first essential step to all of these.
  • The greatest tragedy in mankind's entire history may be the hijacking of morality by religion.
  • It is not easy to see how the more extreme forms of nationalism can long survive when men have seen the Earth in its true perspective as a single small globe against the stars.
  • ক্লার্কের সূত্র

  • Clarke's First Law: When a distinguished but elderly scientist states that something is possible, he is almost certainly right. When he states that something is impossible, he is very probably wrong.
  • Clarke's Second Law: The only way of discovering the limits of the possible is to venture a little way past them into the impossible.
  • Clarke's Third Law: Any sufficiently advanced technology is indistinguishable from magic

    ----

  • SETI is probably the most important quest of our time, and it amazes me that governments and corporations are not supporting it sufficiently.

    ------

  • Wednesday, February 6, 2008

    কম্পিউটার নিরাপত্তার পাঠ - Denial of Service attack বা সেবা-বিঘ্নকারী আক্রমণ

    ডেনাইয়াল অফ সার্ভিস অ্যাটাক বা সেবা-বিঘ্নকরণ আক্রমণ হলো কোনো কম্পিউটার সিস্টেমের কোনো রিসোর্স বা সেবার (service) প্রকৃত ব্যবহারকারীদের বাধা দেয়ার একটি কৌশল। কোনো কম্পিউটার সিস্টেম বা ইন্টারনেট ওয়েবসাইটে এই আক্রমণ চালানোর মাধ্যমে ঐ সিস্টেম বা সাইটের যথাযথ কার্যক্রমকে ধীর গতির, বা অনেক ক্ষেত্রে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়।


    এই আক্রমণ চালানোর একটা বেশ জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো বাইরে থেকে ঐ সিস্টেম বা সাইটের সাথে যোগাযোগের জন্য অসংখ্য বার্তা পাঠাতে থাকা। একটি বার্তা বিশ্লেষণ করতে করতে আরো বেশ কয়টি বার্তা যদি এসে পড়ে, তখন ঐ সিস্টেমটি আক্রমণকারীর পাঠানো বার্তা বিশ্লেষণেই ব্যস্ত থাকে, এবং প্রকৃত ব্যবহারকারীরা ধীর গতির সম্মুখীন হন।


    ডেনাইয়াল অফ সার্ভিস আক্রমণের প্রধান দুটি মাধ্যম হলো

    * টার্গেট করা কম্পিউটারকে রিসেট করে দেয়া, অথবা তার সীমিত রিসোর্সগুলোকে ব্যবহার করে অন্যদের ব্যবহারের অযোগ্য করে ফেলা

    * আক্রমণের লক্ষ্য যে সিস্টেম বা সাইট, তার সাথে প্রকৃত ব্যবহারকারীদের যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধ করে দেয়া।


    উদাহরণ

    ধরা যাক, করিমের একটি সাইট আছে যার নাম কখগ ডট কম। এই ওয়েবসাইটটি যে খানে হোস্ট করা হয়েছে, সেখানে দৈনিক ১ গিগাবাইট ব্যান্ডউইডথ কেনা আছে। দিনে ১০ হাজার হিট হয় এই সাইটে, এবং ৪০০ মেগাবাইটের বেশি ব্যান্ড উইডথ দরকার হয় না। এখন এই ওয়েবসাইটকে আক্রমনকারী শত্রু শওকত একটি স্ক্রিপ্ট লিখে ঐ সাইটে অজস্র ভুয়া হিট করতে থাকলো, ফলে এক ঘণ্টারও কম সময়ে ২৫০০০ হিট করে ১ গিগাবাইট সীমা অতিক্রম করে ফেলা হলো। এখন ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীদের কেউই আর ঐ সাইটে যেতে পারবেন না।


    ধরা যাক, করিম এবার আক্রমণ ঠেকানোর জন্য অসীম ব্যান্ডউইডথের ব্যবস্থা করলেন, এবং শওকতের কম্পিউটারের আইপি অ্যাড্রেস নিষিদ্ধ করে দিলেন। এবার শওকত ভিন্ন পদ্ধতিতে আগালেন ... সরাসরি আক্রমণ করার বদলে "স্মার্ফ অ্যাটাক" (Smurf attack) নামের আক্রমণ করলেন। এই আক্রমণের সময়ে শওকত সরাসরি করিমের কম্পিউটারে আক্রমণ না করে ইন্টারনেটে হাজার হাজার সাইটে ping মেসেজ পাঠালেন। (সংযোগ ঠিক আছে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য ping ব্যবহৃত হয়। এই মেসেজ কোনো কম্পিউটারে পাঠালে ঐ কম্পিউটার মেসেজের জবাবে আরেকটি মেসেজ প্রেরক কম্পিউটারে পাঠায়)। তবে শওকত পিং পাঠানোর আগে কারসাজি করে মেসেজের প্রেরকের নাম পালটে দিলেন, অর্থাৎ প্রেরকের ঠিকানার অংশে নিজের কম্পিউটারের আইপির বদলে করিমের সাইটের আইপি দিয়ে দিলেন। ফলে হাজার হাজার সাইট যখন এই পিং বার্তার জবাব দিবে, তখন সেই জবাব গুলো চলে যাবে করিমের কম্পিউটারে। একই সময়ে আসা এই হাজার হাজার বার্তা গ্রহণ করতে করতে করিমের কম্পিউটার আসল গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগ করার সময় পাবে না। ফলে ওয়েবসাইটটিতে যারা ঢুকতে যাবেন, তাঁরা ব্যর্থ হবেন।

    (কম্পিউটারের জগতের বাইরেও এরকম আক্রমণ চালানো যায়। যেমন ধরাযাক খবিরের মোবাইল ফোনে গনেশ ফোন করতে পারে, তা শওকত চায় না। তাই ফোন ঠেকানোর জন্য অনবরত খবিরকে মিস কল দিতে থাকলো। লাইন ব্যস্ত থাকায় খবিরকে আর গনেশ ফোনে পেলো না। এটাও সেবা-বিঘ্নকরণ আক্রমণের একটা বাস্তব উদাহরণ।)

    (বিস্তারিত জানতে ইংরেজি উইকিপিডিয়ার নিবন্ধ দেখুন)।

    Friday, February 1, 2008

    ছোট গল্প

    গভীর অরণ্য।



    দুটি মানুষ ও একটি বাঘ।




    একটি মানুষ ও একটি বাঘ।



    একটি বাঘ।



    (লেখক আমি নই, বহু আগে কোথাও পড়েছিলাম। গল্প কতো ছোট হতে পারে, তার উদাহরণ।)

    মামু কাহিনী



    মামু, অর্থাৎ আইন-শৃংখলা রক্ষী পুলিশ বাহিনীর সম্পর্কে বাঙালি হওয়ার সুবাদে মনে মনে একটা ভীতি জন্মগত ভাবেই প্রোথিত হয়ে গেছে ... তাই নীল-জামা, কালো-জামা দেখলেই একটু আঁতকে উঠে ভিজা বিড়াল সেজে রই। এহেন এই মামুর সংস্পর্শে দেশে পড়তে হয়নি বেশি, একবার এরশাদ মিঞার লটবহরের গার্ডের তাড়া খাওয়া বাদে।

    তবে চোরের দশদিন, গৃহস্তের/মামুর শেষদিন। কপালে সেই মামুদের মুখোমুখি হওয়া লেখা ছিলো, বিদেশ বিভুঁইয়ে এসেই তা হতে হলো। তাও আবার পিস্তল হাতে রীতিমত ধাওয়া।

    নাহ, ভিজা বেড়ালের মতো শান্ত-শিষ্ট লেজ-বিশিষ্ট এখানেও আমি, তবে ধাওয়া খাওয়ার কাহিনীটাও বিচিত্র। সদ্য দেশ থেকে এসে তখন ক্যাম্পাসের মধ্যে এক দেশী আর এক পাকির সাথে বাসা ভাড়া নিয়েছি। গাড়ি-টাড়ি কিছুই নাই, চলা ফেরার জন্য কিনলাম এক সাইকেল। কিন্তু যেই বান্দার কাছ থেকে কেনা, আমাকে আবুল পেয়ে ধরিয়ে দিলো এক রদ্দি মার্কা মাউন্টেইন বাইক। মাস দুয়েকের মধ্যে চাকার টিউবের রফাদফা।

    দেশে থাকতেও আমার সাইকেল ছিলো, কিন্তু দেশের মতো মোড়ে মোড়ে তো আর সাইকেলের চাকা মেরামতের দোকান আর ৫টাকায় পাংচার মেরামত করা পিচ্চি নাই। নিজে মেরামত করতে গিয়ে ধরা খেয়ে তাই বিরক্ত হয়ে পেছনের চাকাটা খুলে নিয়ে মাইলখানেক হেঁটে সাইকেল বিক্রির দোকানে নিয়ে ঠিক করালাম।

    মার্চ মাস ... স্প্রিং ব্রেক এর বন্ধ ... ক্যাম্পাসের সব চ্যাংড়া পোলাপাইন ফুর্তি করতে বীচ টাইপের জায়গায় কেটে পড়েছে। বিদেশ থেকে আসা "খ্যাত" গ্র্যাড স্টুডেন্টরাই পড়ে আছে ... সেই তালিকায় নাম লেখানো আমি চাকা ঘাড়ে করে বাসায় ফিরে, অ্যাপার্টমেন্টের বাইরের রাস্তায় বসে সাইকেলে চাকা ফিট করা শুরু করলাম। খোলা যতটা সহজ, লাগানো ততোটা না, তাই প্লায়ার্স আর রেঞ্চ হাতে প্যাঁচ দিতে দিতে নাভিশ্বাস উঠার দশা।

    এমন করে চাকায় প্যাঁচ মারতে কখন আমি ব্যস্ত, সামনে কার যেনো ছায়া পড়লো। ফিরে তাকিয়ে তো হার্টফেলের দশা ... রীতিমতো পিস্তল হাতে RAB স্টাইলে পোজ মেরে এক কালো-পোষাকের বিশালদেহী মামু দাঁড়িয়ে। বাজখাই কণ্ঠে আমাকে জিজ্ঞেস করে, "এই, তুমি কী করো?"

    এমনিতেই মামুকে ভয়, তায় আবার পিস্তল হাতে! কাপড় চোপড় নষ্ট হয়নি, কিন্তু খাবি খাওয়ার জোগাড়। আজ অবধি ইংরেজি বলি প্রথমে বাংলাতে বাক্য বানিয়ে তারপরে ট্রান্সলেট করে। পিস্তলের মুখে তো আর তা সহজে হয়না ... আমতা আমতা করতে করতে মুখ থেকে সাইকেল মেরামতি সংক্রান্ত জগাখিচুড়ি কিছু বেরুলো বলে টের পেলাম। আমার অশ্বেতাঙ্গ চেহারা, আর মার্চ মাসের অল্প শীতেও বঙ্গের বিশাল জ্যাকেট গায়ে জবুথবু হয়ে থাকা দেখে মামুর সন্দেহ আরো বাড়লো। ক্যাম্পাস আবার সাইকেল চোরের আড্ডা খানা। পরিচিত সবারই সাইকেল চুরি একবার হলেও গেছে। ব্যাটা তাই পিস্তল আরো বাগিয়ে ধরে প্রশ্ন করলো, "কই থাকো তুমি?"

    পাশের অ্যাপার্টমেন্টটা দেখিয়ে কাজ হলোনা ... আর গোদের উপরে বিষফোড়ার মতো আমার দুই রুমমেটও ঐ সময় বাসার বাইরে ... আমার কাছে চাবিও নাই। ভাগ্য ভালো, দিন দুয়েক আগেই ঠিকানা সহ স্টেট আইডি বানিয়ে এনেছিলাম। গ্রীজমাখা হাতে তড়ি ঘড়ি করে মানিব্যাগ খুলে ওটাই বাড়িয়ে ধরলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক দেখে মামু ব্যাটা একটু আশ্বস্ত হলো, আমি পাশের অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা।

    পিস্তলটা নেমে আসলো, আর দেখি, মামু ওয়াকি টকি বের করে বলে, "Cancel the alert, I don't need backup" !!!! মানে আমার জাব্বা জোব্বা অশ্বেতাঙ্গ চেহারা আর হাতে রেঞ্চ দেখে মামু আমাকে শহরের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বা নিদেনপক্ষে সাইকেল-চোর পার্টির নেতা বলে মনে করেছিলো, আর গোটা কয়েক মামু-গাড়ি ডেকে ফেলেছিলো কাছে আসার আগে!

    যাওয়ার সময় মামু রীতিমত ঝাড়ি দিয়ে গেলো, spring break এর সময়ে বীচে মাস্তি না করে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে আছি কেনো, এই ব্যাপারে। নাকে খত দিয়ে আমিও প্রায় মুচলেকা দিলাম, আর সাইকেল মেরামতির কাজে নামবোনা ... দরকার হলে ঘাড়ে করে নিয়ে যাবো দোকানে।



    পরের সপ্তাহেই আবারো মামু দর্শন হলো, তবে সে আরেক কাহিনী। এও ঐ সাইকেল নিয়েই। সাইকেল-চোর-চক্রকে ধরার জন্য মামু পিস্তল নিয়ে টহল দিচ্ছে এলাকাতে, আগের সপ্তাহে হাতে নাতে তার প্রমাণ পেয়ে আমি বিগলিত, তাই সাইকেলের ইউলকের বদলে কেবল লক (তারের) দিয়ে বাড়ির খুঁটিতে বাইরে বেঁধে রেখেছিলাম। দু'দিনের মাথায় সাইকেল গায়েব! এবার মামু ডাকার পালা আমার ... কোনোদিন আর সাইকেলের দেখা পাবো না যেনেও মনের কষ্টে মামুর কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে বিশাল এক রিপোর্ট লিখালাম। এক "মামী" এসে সরেজমিন তদন্তও করে গেলো, আর জানালো, ক্যাম্পাসে কোথাও সাইকেলটা দেখতে পেলেই যাতে মামু ডাকি। ওরা আবার RAB এর মতো তৎপর না ... বিষ্ণুমুর্তির মতো নিজে থেকে কিছু খুঁজে নাকি দেখাটা ওদের কাজ না।



    একই সপ্তাহে হলো দুইবার মামু দর্শন, আর ঘটনার কেন্দ্রে থাকা সেই সাইকেলটার বিদায়। এর পরেও একবার মামু দর্শন হয়েছে, অবশ্য তা হাইওয়েতে টিকেট দিয়ে কমিশন পাওয়ার আনন্দে উদ্বেল ছোট শহরের মামুর সাথে। বেকুব চেহারা করে সদ্য আম্রিকা আগত ভাব দেখিয়ে ঐবার নিস্তার পেয়েছি। সাইকেল এখন কঠিন মোটা ইউলকে বেঁধে রাখি, আর রাডার ডিটেক্টর দিয়ে মামুর শনি দৃষ্টি খেয়াল করে রাস্তায় চলি। হাজার হোক, মামু বলে কথা ...

    লাইব্রেরি কথন

    মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসার পরে এখানকার মানুষের লাইব্রেরি প্রীতি দেখে বেশ মুগ্ধ হই। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা যমজ শহর শ্যাম্পেইন ও আরবানাতে লাইব্রেরি অনেকগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে এক কোটির উপরে বই আছে (বাংলা বইও আছে বেশ কিছু)। এসব বাদেও রয়েছে প্রতিটি শহরের নিজস্ব লাইব্রেরি, আর সেগুলোতে পাঠকের ভীড়ও যথেষ্ট।

    এদেশে আসার শুরু থেকেই লাইব্রেরিতে আমিও ঘাঁটি গেড়ে বসেছি। বুয়েটে পড়ার সময় লাইব্রেরি থেকে কাজের বই নিতাম খুব কম - বেশি নিতাম ডানদিকের ধুলো পড়া দেয়াল ঘেঁষে থাকা অ-পাঠ্যপুস্তক এলাকার বই। বুয়েটে ইদানিং আর পাঠ্যবই বাদে অন্য কিচ্ছু কেনা হয় না, কিন্তু ষাটের দশকে মার্কিন দাতব্য সংস্থা বই পাঠিয়েছিলো প্রচুর , দান করা সেই বইয়ের মধ্যে সাহিত্য, গল্প, কবিতা, এরকম অনেক কিছুই ছিলো।

    বুয়েটের ছাত্রদের আঁতেল বলে অপবাদ রয়েছে, "আউট বই" (সেকেলে ভাষায় ...) পড়ে সময় নষ্ট করার চাইতে বরং চোথাবাজি টাইপের বা সার্কিট সলিউশন ধরনের শম সিরিজের বইতেই আগ্রহ বেশি। তাই ধুলো জমতে থাকে ঐ শেলফে, বছর বছরে প্রচুর ধুলো। আমি ঐ দিকটায় যাতায়াত শুরু করি ৯৯ সাল থেকে, অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, অনেক বই সেই ষাটের দশক থেকে আজ অবধি কেউ ধরে দেখেনি।

    এর পর থেকে ঐ জায়গাটা আমার খুব প্রিয় হয়ে পড়ে। লাইব্রেরিতে যেতাম ঐখানে ঘুরাঘুরি করার জন্য, আর কোনো ইন্টারেস্টিং বই পাওয়ার জন্য। উচ্চমার্গীয় সাহিত্য অবশ্য আমার মিস্তিরি-মাথার উপর দিয়ে যায়, কিন্তু ওখানে আমার ইন্টারেস্ট সাইন্স ফিকশন, আর ইংরেজি ছোটগল্পের প্রচুর বই ছিলো। "ও হেনরি"র গল্প গুচ্ছ (মনে আছে, সেই "ডেলা অ্যান্ড জিম" এর কাহিনী?) ওখানে পেয়েছি, আরো পেয়েছি হালের জুরাসিক পার্কের লেখক মাইকেল ক্রিকটনের শুরুর দিকে লেখা বই "অ্যান্ড্রোমিডা স্ট্রেইন"। আর শার্লক হোমস? তার সমগ্র পেয়েছিলাম ... পুরাটা ঘেঁটে ফেলেছি।

    শেষের দিকে ঐ তাকের সব বই পড়া হয়ে গিয়েছিলো, অধিকাংশই পুরো ৩০ বা ৪০ বছরে আমিই একমাত্র ইস্যু করেছি ... এমন। বইগুলো নেয়ার সময় লাইব্রেরিয়ান অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাতো আমার দিকে, আজব চিড়িয়া দেখছে, এরকম চাহনীতে। আসে পাশের বিশাল আঁতেল বাহিনী আর বয়েলস্টেডের ইলেক্ট্রনিক্স বইয়ের মাঝে নাক গুঁজে থাকা ছাত্রদের মধ্যে গল্পের বই ইস্যু করতে দেখলে হয়তো চিড়িয়া মনে করাটাই স্বাভাবিক। হাজার হলেও বাঙালি তো, বাধ্য না হলে বই পড়ানো আমাদের কঠিন ... (মুজতবা আলীর লেখাটা হাঁড়ে হাঁড়ে সত্যি)।

    গুগল কথন ৬ - প্রযুক্তির স্রোতে অবগাহন (সমাপ্ত)

    গুগলপ্লেক্সের প্রধান ক্যাফেতে প্রতিদিন দুপুরে বা বিকেলে যেতাম ... ওখানকার ৫ রকমের বিভিন্নদেশী খাবারের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। এই ক্যাফেটার নাম "চার্লি'স ক্যাফে" ... জানতে চেয়েছিলাম একদিন, চার্লিটা কে? জানলাম, চার্লি ছিলো গুগলের প্রথম বাবুর্চি। যখন গুগলের মোট কর্মী সংখ্যা দশ বিশ জন, তখন যোগ দেয়া চার্লি বেতনের বদলে গুগলের কিছু শেয়ার পেয়েছিলো। যখন স্টক মার্কেটে গুগল শেয়ার ছাড়লো বছর কয়েক আগে, ততদিনে সেই সব শেয়ারের দাম হয়েছে কয়েক মিলিয়ন ডলার। সেই মিলিয়নিয়ার চার্লি আজ গুগল থেকে অবসর নিয়ে নিজের রেস্তোঁরা খুলতে পেরেছে, কিন্তু তার নাম রয়ে গেছে।

    গুগলে কাজের পালা শেষ হয় আগস্ট মাসের মাঝামাঝি। তিনটা চমৎকার মাস সেখানে কাটাবার পর বুঝতে চেষ্টা করলাম, কেনো গুগল এতো প্রচন্ড সফল হয়েছে দুনিয়ার সেরা সব প্রোগ্রামারদের আকর্ষণ করতে। শুধু তিনবেলা মজাদার খাবার নিশ্চয় এর কারণ না ... অথবা গুগলের মহামূল্যবান শেয়ার/স্টকও প্রধান কারণ হতে পারে না। সিলিকন ভ্যালির অনেক কোম্পানিরই স্টক/শেয়ারের দাম তর তর করে বাড়ে। তাহলে ব্যাপারটা কী?

    ভেবে চিন্তে যেটা মনে হলো, গুগলের প্রধান সাফল্যের পেছনে রয়েছে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, আর কর্মীদের কাজ করার অশেষ স্বাধীনতা দেয়া। এখানে সবাই সপ্তাহে একটা পুরো দিন পায় নিজের ইচ্ছা মতো কোনো কিছু নিয়ে কাজ করার। সেটা গুগলের কাজে আসুক বা না আসুক, কোনো সমস্যা নেই। এমনকি অন্য কাজের ডেডলাইন থাকলেও সপ্তাহে ঐ এক দিন সবাই পাবেই। আরো দেখেছি, পারস্পরিক সম্মান দেয়া। দেশে থাকতে দেখতাম, কোম্পানির মালিক তো বটেই, অফিসের বড়কর্তা তাদের অধীনস্ত সবাইকে "তুমি" বলে সম্বোধন করছে, আর অন্য সবাই বড়কর্তাদের হুজুর-সালাম দিয়ে চলেছে। কিন্তু গুগলে যেদিন ক্যাফের সাধারণ কর্মীদের খাবার লাইনে আমার ঠিক সামনে গুগলের প্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিনকে অন্য সবার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, তখন বুঝলাম এখানে পদমর্যাদার জোর খাটানো নেই। অফিসে গ্রুপের মিটিং থেকে শুরু করে সর্বত্র এটা অনুভব করেছি ... তিন মাসের জন্য আসা শিক্ষানবিশ ইন্টার্ন বলে আমার মতামতকে কেউ অবজ্ঞা করেনি, বরং যুক্তিসঙ্গত মতামত, অভিমত - এসব সবাই যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে নিয়েছে।


    কর্মীদের অজস্র সুবিধা দেয়া, তিনবেলা রাজভোগ খাওয়ানো, কনফারেন্স বাইকে আড্ডা - এসবের মাধ্যমে মানুষ অফিসে বসে থাকছে সারাদিন, তা সত্যি, কিন্তু আসল কাজের উদ্দীপনা আসছে কাজের পরিবেশ, আর নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে দেয়ার সুযোগ পাওয়ার মধ্য দিয়ে। আর সেই সাথে মজা করার অসংখ্য সুযোগ তো আছেই ... দুই দিন পর পরই অফিসের সবাই হই চই করে ঘুরে বেড়াতো বিভিন্ন স্থানে। আমার এই তিন মাসের মধ্যেই ৪টা অফিস পিকনিক হয়েছে ... আর অন্য সময় একেবারে স্কি-করার ট্রিপ থেকে শুরু করে আরো অনেক চমৎকার অফ-সাইট ট্রিপ হয়ে থাকে। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারের কোম্পানি মিটিং এর কথা আগেই বলেছি ... সেটাও এক বিশাল পার্টি। আর গুগলে কাজ করে নানা দেশের নানা ধর্মের লোকজন ... সবার জন্যেই সব রকম ব্যবস্থা রয়েছে। চীনা আর কোরীয় খাবারের উপরে আলাদা আলাদা একটা করে ক্যাফে তো আছেই, আর সেই সাথে বিভিন্ন উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন হয় মূল ক্যাফেতেও। আমি থাকার সময় ভারতের ৬০তম জাতীয় দিবস উপলক্ষে চার্লি'স ক্যাফেতে বিশাল খাবার দাবারের আয়োজন হলো। আবার শুক্রবারে মুসলমান কর্মীদের জন্য বিশেষ হালাল খাবারের ব্যবস্থা দেখেছি। শুনেছি, রমজান মাসে ক্যাফে গুলোতে ইফতারের ব্যবস্থাও করা হয় মুসলমানদের জন্য।

    গুগলের কর্মী সংখ্যা আজ ছাড়িয়ে গেছে ১০ হাজারের উপরে। তবে একটু মন খারাপ হলো এটা ভেবে, শিশির, সবুর, আর অল্প দুই-একজন ছাড়া এখানে বাংলাদেশী কর্মী নেই বললেই চলে। অথচ বাংলাদেশে প্রতিভার অভাব নেই। যে কয়দিন কাজ করেছি, মনে হয়েছে, এখানে কাজ করার মতো যোগ্যতা বাংলাদেশের অনেক প্রতিভাবান প্রোগ্রামারের রয়েছে। আমি আশাবাদী ... ভবিষ্যতে, বছর কয়েক পরেই গুগলে বাংলাদেশের আরো অনেক প্রাণবন্ত মুখের আবির্ভাব ঘটবে। ভারতের বাঙ্গালোর, দিল্লী, আর হায়দরাবাদের মতো বাংলাদেশেও গুগলের গবেষণাকেন্দ্র স্থাপিত হবে।

    ---

    অনেক মজার, অনেক স্মৃতির শেষে গুগলে কাজের পালা শেষ হলো আমার আগস্টের ১৭ তারিখে। শেষের দুই তিন দিন আমাদের বিদায়ী অনুষ্ঠানে কেটে গেলো, আমার হোস্ট রিচার্ড আর ব্রায়ানের সাথে পুরো অফিসের সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া হলো বিভিন্ন স্থানে। একেবারে শেষ দিনে গুগলপ্লেক্সকে বিদায় জানাতে বেশ খারাপ লাগছিলো। তবু জীবনের গান চলতেই থাকে, ঘুরতে থাকে প্রযুক্তির স্রোতে গুগলের কর্মীদের অবগাহন, এগিয়ে চলে পৃথিবী।

    Monday, January 21, 2008

    গুগল কথন ৫ - কর্মীরা যেখানে রাজা

    গুগলের কর্মীদের সাথে কাজ করতে করতে অল্প দিন পরেই যেটা লক্ষ্য করি, সবাই প্রচন্ড কাজ পাগল। দিনে ৮ ঘন্টা কাজ করার জন্য গুগল পয়সা দেয়। কিন্তু গুগলের কর্মীরা অফিসে থাকে আরও অনেক বেশি সময়। কাজে আসার ক্ষেত্রে ধরাবাঁধা সময় নেই, যে যার মতো সময়ে আসতে পারে। অফিসে প্রথম দিনেই আমার বসকে প্রশ্ন করেছিলাম, কয়টার সময় আসতে হবে। রিচার্ড (আমার বস) বললো, তোমার যখন ইচ্ছা তখনই আসতে পারো। রিচার্ড আসতো সকাল নয়টার সময়, আর যেতো বিকাল ছয়টায়। আমি অবশ্য নয়টায় আসতামনা প্রতিদিন, যেতাম সাড়ে নয়টা বা দশটায়, আর বেরুতাম অফিস থেকে সাড়ে ছয়টা বা সাতটার দিকে। আমাদের গ্রুপের অন্য সদস্য ব্রায়ান এগারোটার দিকে এসে থাকতো রাত নয়টা সাড়ে নয়টা পর্যন্ত।

    কাজে ডুবে থাকার এই সাধারণ প্রবণতাটার পেছনে কারণটা কি, বুঝতে শুরু করলাম কয়েক দিন পর থেকেই। সিলিকন ভ্যালিতে কাজ পাগল মানুষদের কষ্টের ফসল হিসাবে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, কিন্তু তাদের মধ্যেও গুগলের কর্মীদের অফিসে পড়ে থাকার আপ্রাণ চেষ্টাটা বেশি। আসলে এর পেছনের সবচেয়ে বড় কারণ হলো অফিসের পরিবেশটাকে অসাধারণ করে রাখা।

    শুরুতেই বলা যায় অফিস ও তার আসেপাশের স্থাপনা। আমার অফিসটার পাশে ল্যান্ডস্কেপিং করে ফোয়ারা, জলপ্রপাত, আর মিনি সাইজের লেক বানানো। ফুলের বাগানে গুগলের লোগোতে ব্যবহৃত মৌলিক বর্ণের নানা ফুল সাজানো আছে বিচিত্র নকশায়। প্রথমবার গেলে পার্ক বলে ভ্রম হতে পারে।


    অফিসের ভেতরে আবার খাবারের ছড়াছড়ি। আগেই বলেছিলাম একবার, অফিসের প্রতি ১৫০ ফুট পর পর একটা মাইক্রোকিচেন রয়েছে। এর মানে হলো, দুই তিনটা বিশাল ফ্রিজে ভর্তি রয়েছে খাবার থরে থরে - স্যান্ডউইচ, চকলেট, কম করে হলেও ১০-১৫ রকমের ফলের রস, ডাবের পানি, কোক/পেপসির ক্যান, স্পেশাল মিনারেল ওয়াটার, আর এনার্জি ড্রিংক। পাশের টেবিলে বাদাম, চিপস, ফল, বীফ জার্কি (মাংশের শুটকি), এরকম অনেক কিছু। আর কফি তো আছেই। সবই ফ্রি - যার যখন ইচ্ছা এসে খেয়ে যাচ্ছে, বা দু-হাত ভর্তি করে অফিসে নিয়ে যাচ্ছে ভুরি-ভোজনের জন্য।


    এতো গেলো কেবল মাইক্রোকিচেনের কথা। প্রতিটা অফিস ভবনেই রয়েছে একটা করে ক্যাফে। পুরো গুগলপ্লেক্স এলাকাতে ভবন ১৬টা, তার মানে বুঝতেই পারছেন, ক্যাফের সংখ্যাও ১৬। আর ক্যাফেগুলো মোটেও গতানুগতিক নয়, একেকটা ক্যাফে একেকটা ধাঁচে সাজানো। যেমন আমার অফিসের ক্যাফের নাম "অফ দা গ্রিড", ওখানে একটু অন্য রকমের বিচিত্র প্রকারের খাবার দিতো। নিজের ইচ্ছে মতো সালাদ বানিয়ে নেয়া, সব্জ্বীর নানা রান্না, আর মাংশের কিছু আইটেম। প্রায় দিনেই অদ্ভুত সব খাবার আসতো, যেমন ক্যাঙ্গারুর বার্গার, হরিণের মাংসের কাবাব, এরকম। সপ্তাহে একদিন বারবিকিউ হতো বাইরে, ঐ যে লেক আর জলপ্রপাতের কথা বলেছি, তার পাশে চাদর বসিয়ে পিকনিকের মতো করে খাওয়া চলতো। আর সকালে প্রতিদিন থাকতো ডিমভাজি সহ নানা রকমের নাস্তা, বিকেল ৩টার সময় আবার বিকালের নাস্তা দিয়ে পেট পুজার ব্যবস্থা থাকতো।

    পাশের ভবনেই ফাইভ নামের ক্যাফে, প্রতিটা খাবারে ঠিক ৫টা করে উপাদান দিয়ে তৈরী। আরেকটা ক্যাফে ছিলো ইউরোপীয় খাবারের। আরেকটা (প্যাসিফিক ক্যাফে) হলো চীনা, জাপানি সুশি ও অন্যান্য খাবারের। বিল্ডিং ৪৪এর ক্যাফেটা ছিলো স্লাইস - ওখানে রয়েছে দুর্দান্ত ফলের রস আর স্মুদি (লাসসি টাইপের)।

    তবে সব কিচ্ছুকে ছাড়িয়ে যায় গুগলপ্লেক্সের কেন্দ্রস্থলের "চার্লিজ ক্যাফে"। গুগলের প্রথম শেফ ছিলো চার্লি, তবে বেতনের বদলে শুরুতে গুগলের শেয়ার পেতো বলে চার্লি এখন মিলিয়নিয়ার হয়ে রিটায়ার করেছে, তার নামেই এখন রয়ে গেছে ক্যাফেটা। বিশাল ফুটবল মাঠের সাইজের ঐ ক্যাফেতে ৫টা সাবক্যাফে ছিলো - নমস্তে হলো ভারতীয় খাবারের, পাশেরটা জাপানী খাবার আর ইতালীয় খাবারের ক্যাফে, তার সামনেরটা "ইস্ট মীটস ওয়েস্ট" অর্থাৎ ফিউশন ধাঁচের। এছাড়াও ছিলো মেক্সিকান খাবার আর গতানুগতিক মার্কিন/ইউরোপীয় খাবারের দুটো সাব ক্যাফে। এগুলোতে প্রতিদিন দুপুর আর সন্ধ্যাতে ভীড় হতো প্রচন্ড। পুরোটা অবশ্য প্রচন্ড সুশৃংখল, সবাই ট্রে নিয়ে লাইন বেঁধে খাবার নিয়ে টেবিলে, অথবা বাইরের মাঠে বসানো পিকনিক টেবিলে চলে যায়। প্রতিদিন কম করে হলেও হাজার চারেক কর্মী এখানে খেয়ে থাকে। ভারতীয় বা চীনারাতো মনে হয় বিকেল বেলাতে পুরো পরিবারের বাপ, মা, বাচ্চা কাচ্চা সহ গোটা দশেক লোক সাথে নিয়ে আসে। উল্লেখ্য, প্রত্যেকেই অতিথি নিয়ে আসতে পারে, কোনো বাঁধা নেই। আর খাওয়া যে ফ্রি, তা তো আগেই বলেছি।

    গুগলের এই খাওয়ার অঢেল ব্যবস্থার কারণে নতুন আসা গুগল কর্মীরা হাপুস হুপুস করে খেতে থাকে, নিজের চোখে দেখা। "গুগল ফিফটিন" বলে কথা চালু আছে, গুগলে ঢোকার প্রথম দুই সপ্তাহে নাকি কর্মীদের ওজন বাড়ে ১৫ পাউন্ড অন্তত।

    শুধু কি খাওয়াই মূল আকর্ষণ? মনে হয় না, কারণ গুগলের অন্যান্য ব্যবস্থাও চমৎকার। চুল কাটা দরকার? কোন সমস্যা নেই, গুগলের চুল কাটার মিনিবাস আছে একটা, সারা দিন অফিসে অফিসে ঘুরতে থাকে, জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে পেলেই নেমে গিয়ে চুল কেটে ফেলা যায়। গাড়ির অয়েল চেইঞ্জেরও ব্যবস্থা আছে। আর ঐ রাজভোগ খেয়ে ওজন বাড়লে ভুড়ি কমানোর জন্য রয়েছে জিম। বাচ্চাদের রাখার জন্য নার্সারি। ডাক্তার, ডেন্টিস্ট। আর কাজ করতে করতে অবসন্ন বোধ করলে ম্যাসেজ করার জন্য অটোম্যাটিক চেয়ার ম্যাসাজ, বা এক ঘন্টার টেবিল ম্যাসাজের ব্যবস্থাও রয়েছে। আর যাতায়াতের জন্যও অনেক ব্যবস্থা -- নিজের গাড়ি না থাকলে বা প্রতিদিন ড্রাইভ করতে ইচ্ছা না হলে গুগলের শাটল গিয়ে নিয়ে আসবে, এমনকি ৪০ মাইল দূরের সান ফ্রান্সিস্কো থেকেও অনেকে গুগলের বাসে করে আসে। আর গুগলের ইলেকট্রিক গাড়িও অনেক কর্মীকে দেয়া হয়, চালাবার জন্য।

    আর সব সময় কাজ করা? তা নয় মোটেও, বরং খেলাধুলার ব্যবস্থা রয়েছে বিস্তর। ক্যাফের পাশেই ভলিবল কোর্ট, আর টেনিস খেলা, সাঁতার কাটা, কৃত্রিম স্রোতে সার্ফিং এর ব্যবস্থা, এসব তো রয়েছেই। কিন্তু তার চেয়েও ইন্টারেস্টিং হলো ভিডিও গেইমের কালেকশান, বাংলাদেশে আমরা যেমন খেলতাম কয়েন অপারেটেড মেশিন, সেরকম মেশিন সাজানো আছে। আমার অফিসের এক কোনাতে একটা বড় স্ক্রিন পেয়ে তো একজন দেখি রীতিমত ভিডিও গেইম কর্নার বানিয়ে ফেলেছিলো, উইই, পিএসপি, আর অন্য সব মেশিন দিয়ে।


    সিলিকন ভ্যালির অন্যত্র অবশ্য এতোটা সুযোগ সুবিধা নেই। আমার বন্ধু কেউ কেউ ইন্টেলে কাজ করেছে, ওদের ক্যাফেতে নাকি পানিটাও কিনে খেতে হতো। গুগলের কর্মীরা থাকে রাজার হালে। অবশ্য এর পেছনে গুগলের লাভটাও অনেক। কর্মীদের এভাবে রাজার হালে রেখে রেখে অফিসে ধরে রাখাটা খুব সহজ হয়, সকাল থেকে এসে সবাই রাত করে ফিরে, মাঝের সময়টাতে পাগলের মতো কাজ করে চলে। আর মনে ফুর্তি আনার মতো সব ব্যবস্থা আছে বলে সারাদিন চরম উৎসাহে, আগ্রহে তৈরী করে চলে অসাধারণ সব সফটওয়ার।

    Saturday, January 19, 2008

    গুগল কথন - ৪ : ব্রিন আর পেইজের কথা

    সের্গেই ব্রিন আর ল্যারি পেইজ গুগলের প্রতিষ্ঠাতা দুই টগবগে তরুণ। তাঁদের পরিচয় হয় স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পিএইচডি করার সময়, আর ঐ সময়েই দুজনে মিলে পেইজর‌্যাংক নামের একটি অ্যালগরিদম লিখেন। পেইজর‌্যাংকের মূল লক্ষ্য ছিলো ইন্টারনেটের ওয়েবপেইজগুলোর সম্পর্ক বের করা, কোনো পেইজের গুরুত্ব বের করে ঐ অনুযায়ী একটা ক্রম বের করা। ব্যাস, এই পেইজর‌্যাংক অ্যালগরিদমটিই সার্চ ইঞ্জিন হিসাবে গুগলের সূচনা করে দেয়। আগের সার্চ ইঞ্জিনগুলো কোন কোন ওয়েবপেইজে অনুসন্ধিত শব্দগুলো আছে, তা বের করতে পারতো, কিন্তু ওয়েবপেইজগুলোর র‌্যাংকিং ভালো ভাবে করতে পারতোনা বলে সার্চের ফলাফল ভালো আসতোনা।

    সার্চ ইঞ্জিন হিসাবে গুগলের মান অনেক ভালো, এটা বোঝার পরে ব্রিন আর পেইজ গুগলকে একটা স্টার্ট-আপ কোম্পানি হিসাবে শুরু করেন ১৯৯৮ সালে। সিলিকন ভ্যালির অন্য অনেক নামজাদা কোম্পানির মতোই গুগলের যাত্রা শুরু হয় একটা গ্যারেজে, কিছু কম্পিউটার সার্ভার নিয়ে। গুটি কয়েক প্রোগ্রামার নিয়ে শুরু করা সেই গুগল আজ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে মূল্যায়িত এক মহীরূহে পরিণত হয়েছে।

    কিন্তু, ব্রিন আর পেইজকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। এখনও দুজনে মাটির মানুষ, ভাবভঙ্গীতে সেই পিএইচডি করতে থাকা গ্র্যাজুয়েট স্কুলের ছাত্রের মতো। গুগলে ইন্টার্নশীপ পাওয়ার সময় ভেবেছিলাম, পুরা গুগলের সবার বস ব্রিন, পেইজ, এবং গুগলের সিইও এরিক স্মিড্‌টকে আদৌ চোখে দেখতে পাবো কি না। বাংলাদেশে অন্য কারো কথা বাদ থাক, বুয়েটের শিক্ষকতা করার সময়েও বুয়েটের ভিসির সাথে দেখা করতে এক দিন ঘন্টা পাঁচেক বসে থাকতে হয়েছিলো। কোম্পানিগুলোর কথা তো বাদই দিলাম ... কোনো কোম্পানিতে সদ্য যোগ দেয়া কেউ কি আশা করতে পারে, কোম্পানির মালিকের সাথে সরাসরি কথা বলা বা বেফাঁস প্রশ্ন করা যাবে?

    প্রথম দিনেই ধারণাটা পালটে গেলো, ব্রিন আর পেইজকে দেখে। প্রতি শুক্রবার গুগলে এক বিশাল পার্টি হয়। টিজিআইএফ, অর্থাৎ থ্যাংক গড ইটস ফ্রাইডে হলো এই পার্টির নাম। আসলে সোমবার থেকে কাজ শুরু হয়ে শুক্রবার আসতে আসতে মানুষের মেজাজ খিঁচড়ে যায়, কাজের চাপে মাথা গরম হয়ে থাকে। শুক্রবার আসলে আসন্ন দুই দিনের উইকেন্ড বা সপ্তাহান্তের ছুটির আনন্দে শুকরিয়া করে ... তাই থেকেই এই মিটিংটার নাম হয়েছে। যাহোক, এই মিটিং এর মোদ্দা কথা হলো, গুগলের বিশাল ক্যাফেটাতে হাজার কয়েক গুগল ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য কর্মী জড়ো হবে, বিশাল একটা খাওয়া দাওয়া চলবে, আর মঞ্চে দাঁড়িয়ে ব্রিন আর পেইজ গল্প গুজব করবে।

    ওখানে হাজির তো অবাক। দেশে থাকতে দেখতাম, কোনো কোম্পানির বড়সাহেব, এমন কি সরকারী কোনো অফিসের জিএম সাহেবের বিশাল ভাব, আর আশে পাশে চামচার দল, অনেক সময় সিকিউরিটির লোকজনের হুমকি ধামকি। সে তুলনায় দুনিয়ার বিলিয়নিয়ারদের তালিকায় ২৬ তম স্থানে থাকা ব্রিন ও পেইজকে (প্রত্যেকের সম্পত্তির পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন ডলার করে) দেখে বোঝারই উপায় নেই, ওরাই এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এবং অধিকাংশ শেয়ারের মালিক। মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রতি শুক্রবার ওরা প্রথমে এই সপ্তাহে কি কি প্রডাক্ট গুগল ছাড়ছে, তার কথা বলে খানিক ক্ষণ। অনেক প্রডাক্ট, যেমন স্ট্রিট ভিউ, মার্কেটে আসার আগেই ভিতরের সবাইকে জানানো হয়। এর ফাঁকে ফাঁকে ব্রিন ও পেইজের ভাড়ামি চলতে থাকে, অনেকটা "ইত্যাদি" অনুষ্ঠানের মতো করে দুইজন নানা রকমের রসিকতা করতে থাকে। ব্রিনের জন্ম ও শৈশব কেটেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের কড়া সমাজতন্ত্রী শাসনে, সেটা নিয়ে ওকে পেইজ প্রায়ই ঠাট্টা করে। ব্রিনও কপট গাম্ভীর্য দেখিয়ে হাঁসাতে পারে ভালোই।

    এর পরেই শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। এই পর্বে গুগলের কর্মীরা সরাসরি, বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রশ্ন করতে পারে ব্রিন, পেইজ, এবং এরিককে। আর এই পুরো ব্যাপারটাই খুব [ইংলিশ]transparent[/ইংলিশ], যে কোনো ধরণের প্রশ্ন যে কেউ নির্ভয়ে বলতে পারে। এমন কি গুগলের কোনো একটা পদক্ষেপ খুব বাজে এবং নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক, এরকম প্রশ্ন করতেও কোনো বাঁধা নেই। আমি যে কয়দিন এই অনুষ্ঠানে গিয়েছি, দেখেছি গুগলের কর্মীরা প্রত্যেক দিনই এরকম প্রশ্ন করছেন। যেমন, গুগল ভিডিও বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত কেনো নেয়া হলো, কেনো ইবে কে গুগল খেপিয়ে দিলো, এরকম। অনেক প্রশ্ন এমন, যেন ব্রিন ও পেইজকে রীতিমত জবাবদিহি করতে বলার মতো। ভাবতে পারেন, বাংলাদেশের কোনো কোম্পানির মালিকদের এরকম প্রশ্ন করা হচ্ছে, আর প্রশ্ন করছে একেবারে নতুন কর্মীরা? গুগলের চমৎকার পরিবেশে আসলে এটাই খুব স্বাভাবিক।

    ব্রিন আর পেইজকে প্রশ্ন করার সুযোগ আমিও হাতছাড়া করিনি। অনলাইনে যে প্রশ্ন করার ব্যবস্থা আছে, তাতে শুক্রবার সকাল বেলা প্রশ্ন দিলে বিকাল নাগাদ ভোটাভুটিতে যে প্রশ্ন টিকে যায়, সেটাই করা হয়। বেশ কয়েক সপ্তাহ চেষ্টা করে আমার প্রশ্নটা একদিন প্রথম ১০টি প্রশ্নের মধ্যে আসলো। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, বাংলাদেশের দিকে গুগলের নজর কবে পড়বে, আর গুগল যেসব ভাষাকে প্রাধান্য দেয়, তাদের মধ্যে ২৫ কোটি লোকের মুখের ভাষা বাংলা কবে আসবে।

    প্রশ্নের জবাব সের্গেই ব্রিন খুব আগ্রহের সাথেই দিলো। বললো, গুরুত্ব দেয়ার ব্যাপারটা অনেকটা অর্থনীতি ভিত্তিক। বাংলাদেশে কয়েক কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী আছে, তাই অচিরেই ঐ দিকে গুগল চিন্তা করবে, মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য কাজ করবে। আরেকটা ব্যাপার হলো, বাংলা ভাষায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কেমন, সেটা দেখতে হবে ... বাংলাদেশ থেকে যত মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাঁদের কতজন বাংলায় গুগল সার্চ করেন, ইংরেজি গুগলের বদলে, তাও বিবেচ্য। এসব কিছু বিবেচনা করে অচিরেই গুগল বাংলার উপরে কাজ শুরু করবে।

    ব্রিন অবশ্য সিরিয়াস কমই থাকে, আগেই বলেছি। ব্যাগি প্যান্ট আর টি শার্ট পরা ব্রিনকে দেখলে মনে হয়, ইউনিভার্সিটির ল্যাব থেকে বেরিয়ে এসেছে এই মাত্র। পেইজকেও তাই। আর গুগলের প্রতিষ্ঠাতা হলেও চামচা বাহিনী নিয়ে ঘুরবে, বা তাঁদের ঘিরে বডিগার্ডের দল থাকবে, তা না। একদিন মজার ব্যাপার হলো, আমি সেদিন গিয়েছি বিল্ডিং ৪৩ এর নো-নেইম ক্যাফেতে। খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ মনে হলো, সামনের লোকটাকে চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছি ভাবতে ভাবতেই টের পেলাম, এটা সের্গেই ব্রিন। মনে হলো, ভলিবল কোর্টে অন্য কর্মীদের সাথে খেলে এসে এখন খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, অন্য সব সাধারণ গুগল কর্মীদের সাথে।

    সিলিকন ভ্যালির সবাই বেশ ইনফর্মাল, তবে গুগলের মতো এতোটা না। ব্রিন আর পেইজের মতো মাটির কাছে থাকা মানুষদের দেখলে বোঝা যায়, কেনো গুগলের অন্য কর্মীরা এতো উৎসাহের সাথে কাজ করে থাকে। আর এজন্যেই কাজ করার জায়গা হিসাবে ফর্বস ম্যাগাজিনের জরীপে সব কোম্পানিকে পেছনে ফেলে গুগল এখন ১ নাম্বারে।

    গুগল কথন - ৩ : গুগলপ্লেক্সের ভিতরে বাইরে


    ইন্টার্নশীপের প্রথম দিনেই হাজির হলাম গুগলের সদর দপ্তরে। এতো বিখ্যাত কোম্পানি, কিন্তু নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি নেই। প্রথম দিনে লবিতে আমার ইন্টার্নশীপের কাগজপত্র আর আইডি দেখানোর পরে ছবি সহ গুগল ব্যাজ দেয়া হলো। ব্যাস, এই ব্যাজ থাকলে গুগলের সর্বত্র অবাধে আসা যাওয়া করা সম্ভব।

    গুগলের প্রধান অফিসকে বলা হয় গুগলপ্লেক্স। প্রযু্ক্তির প্রাণকেন্দ্র সিলিকন ভ্যালির একেবারে কেন্দ্রস্থল মাউন্টেইন ভিউ শহরে এর অবস্থান। আসলে সান ফ্রান্সিস্কো হতে সান হোসে পর্য্ত প্রায় ৪০ মাইল লম্বা যেই উপদ্বীপ আকারের এলাকা, তার পুরোটাই আধুনিক প্রযুক্তি ভিত্তিক ব্যবসার কেন্দ্র। মাউন্টেইন ভিউ এর পাশেই স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, পালো আল্টো নামের শহরে। প্রযুক্তিগত বিভিন্ন বিষয়ে এখানে অভাবনীয় সব গবেষণা হয়ে চলেছে শ খানেক বছর ধরেই, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের দিক থেকেও এটা দুনিয়ার প্রথম কাতারে। নামজাদা সব মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, বিশেষত ইদানিংকার অধিকাংশ সফটওয়ার কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা অনেকেই এখানকার ছাত্র ছিলেন। গুগলের সের্গেই ব্রিন আর ল্যারি পেইজ তো বটেই, ইয়াহু!র প্রতিষ্ঠাতা ফিলো এবং ইয়াং, সানের প্রতিষ্ঠাতা ম্যাকনিলি, বিনোদ খোসলা - এরা সবাই স্ট্যানফোর্ডে পড়ার সময়ে বা পাস করেই নিজেদের কোম্পানিগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর সেই কারণেই পালো আল্টো বা মাউন্টেইন ভিউতে এই সব কোম্পানির সদর দপ্তর গড়ে উঠেছে।

    ফিরে আসি গুগলপ্লেক্সের কথায়। গুগলের শুরুটা হয়েছিলো ব্রিন ও পেইজের এক বন্ধুর গ্যারেজে, মাত্র কয়েকটি কম্পিউটার নিয়ে। মেনলো পার্কের ঐ গ্যারেজে পরে গুগল চলে আসে পালো আল্টো শহরে। কিন্তু গুগলের অভাবনীয় সাফল্যের কারণে জায়গার দরকার বাড়তে থাকে অচিরেই। তাই ২০০৩ সাল এক কালের নামকরা কোম্পানি সিলিকন গ্রাফিক্সের ১৬০০ অ্যাম্ফিথিয়েটার পার্কওয়েতে অবস্থিত বিশাল হেড কোয়ার্টারটি গুগল ভাড়া নেয়। এখানে রয়েছে চারটি ভবন - বিল্ডিং ৪০, ৪১, ৪২, এবং ৪৩। আগেই বলেছিলাম, এই চারটি ভবনের মাঝখানের চত্ত্বরের বিশাল ডাইনোসরটির কথা। এছাড়াও মাঝখানের চত্ত্বরে রয়েছে একটি ভলিবল কোর্ট। সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেউ না কেউ খেলে বেড়াচ্ছে ... দেখলে মনে হবে অফিস নয়, বরং একটা হোটেলের খেলার কোর্ট। অনেকের কাছে শুনেছি, বিকেলের দিকে সের্গেই ব্রিন বা পেইজও নাকি যোগ দেয় খেলাতে। আমার অফিসটা অবশ্য একটু অন্যপাশে থাকায় সেই দৃশ্য দেখিনি।

    এর পাশেই ক্যাফের চত্ত্বর। গুগলের সুবিখ্যাত খাওয়া দাওয়া নিয়ে পরে লিখবো। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেরা সেরা সব রেস্তোঁরার খাওয়াকেই গুগলের ক্যাফেগুলো হার মানায়। মোট ক্যাফের সংখ্যা এখানে ১৫টি। একেক ক্যাফে একেক রকমের - প্রধান ক্যাফেটা গুগলপ্লেক্সের বিল্ডিং ৪০এর চার্লিজ ক্যাফে। ওখানে এক সাথে প্রায় কয়েক হাজার লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় প্রতিদিন।

    আমাদের ওরিয়েন্টেশন হয়েছিলো বিল্ডিং ৪৩ আর ৪২ এর বিশাল অডিটোরিয়ামে। প্রথম দিনের সব কাজ কর্ম শেষে পুরো গুগলপ্লেক্স ঘুরে দেখানো হলো। প্রতিটি তলাতেই একটু পর পর মাইক্রো কিচেন আছে, যাতে থরে থরে সাজানো আছে নানা রকম ফলের রস, চিপ্স, আইসক্রিম, ডাবের পানি, চকলেট, স্যান্ডউইচ থেকে শুরু করে কতো কি!! এই ব্যাপারে নাকি সের্গেই ব্রিনের একটা নীতি আছে, "কোনো মানুষকেই খাবার দাবারের থেকে দেড়শো ফুটের বেশি দূরে রাখা ঠিক না"। কাজ করতে করতে একটু খিদে পেলেই দূরে যাবার দরকার নেই, অফিস থেকে দুই পা হাঁটলেই একটা মাইক্রোকিচেন, আর সেখানে এরকম জিভে জল আনা সব খাবার।

    গুগলপ্লেক্সের চারটি ভবন ছাড়াও এই এলাকাতেই কেবল গুগলের অফিস রয়েছে মোট ১৬টি। এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত প্রায় ২ মাইল দূরত্ব। আমার অফিসটি পড়েছিলো পশ্চিম পাশে। অবশ্য এক অফিস থেকে আরেক অফিসে যাবার জন্য অনেক ব্যবস্থা আছে। পুরো ক্যাম্পাসের প্রতিটি ভবনের সামনেই রয়েছে গুগলের মনোগ্রাম লাগানো বাই সাইকেল বা জি-বাইক। যে কেউ যে কোনো জি-বাইক নিয়ে অন্য অফিসের সামনে গিয়ে পার্ক করে রাখে, পরে আবার সেটা অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারে। তালা মারার ব্যাপার নেই। এটা ছাড়াও রয়েছে ইলেকট্রিক স্কুটার, শাটল বাস, এবং দুই চাকার অদ্ভুত যান সেগওয়ে। কিন্তু সবকিছুকে হার মানায় মাকড়শার মতো আকৃতির কনফারেন্স বাইক। প্রথম যেদিন দেখলাম, অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মাকড়শার অনেক গুলো পায়ের মতো এই বাইকের সাতটি বসার জায়গা বৃত্তাকারে বসানো, কেন্দ্রের একটি বিন্দুতে যুক্ত। বসার সময় কেন্দ্রের দিকে মুখ করে সবাই বসে। প্রতিটি সিটের নীচে প্যাডেল রয়েছে। সবাই প্যাডেল চালালে এক অদ্ভুত উপায়ে সেটা এক সাথে যুক্ত করে বাইকটিকে চালায়। আটজনের মধ্যে একজনের হাতে স্টিয়ারিং থাকে, সে এটা কোনদিকে যাবে তা ঠিক করে। আর এই বাইকের নাম কেনো কনফারেন্স বাইক হলো? আসলে গুগলের প্রকৌশলীরা কনফারেন্স রুমে মিটিং না করে অনেক সময় এই বাইকে মজা করে চালাতে চালাতে মিটিং করে থাকে, এমনকি ল্যাপটপে করে ইন্টারনেটে যোগাযোগ, সবই করা সম্ভব এটাতে।


    গুগলপ্লেক্সে মোট কাজ করে হাজার ছয়েক মানুষ। এদের অজস্র গাড়ি পার্ক করার জন্য যে পার্কিং লট রয়েছে, গুগল সেটাকেও অন্যভাবে কাজে লাগিয়েছে। গুগলপ্লেক্সের স্যাটেলাইট ছবিতেই দেখবেন, পুরো গুগলপ্লেক্সের উপরের ছাদ, এমন কি পার্কিং লটের অনেক অংশের ছাউনির উপরে সোলার প্যানেল বসানো। এই সোলার প্যানেলগুলো থেকে প্রতিদিন যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যুত উৎপাদন করা হয় - দিনে গড়ে ২ মেগাওয়াটেরও বেশি। আর গুগলের নিজস্ব আরেকটা প্রজেক্ট হলো প্লাগ-ইন হাইব্রিডের গবেষণা, অর্থাৎ এমন গাড়ি বানানো, যা বাসার ইলেক্ট্রিক সকেটে প্লাগ ঢুকিয়ে চার্জ করে নেয়া যাবে।

    থাক, আজ এতটুকুই, পরের পর্বে গুগলের বিখ্যাত খাবার দাবারের গল্প করা যাবে ...