Saturday, March 22, 2008

স্টেরিওটাইপের কথকতা

স্টেরিওটাইপ শব্দটা মূলত ঋণাত্মক অর্থেই ব্যবহৃত হয় ... কাউকে তার কোনো বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ঢালাও ভাবে কিছু একটা ভাবাই এর অর্থ। কমেডি ঘরাণার মূল কৌশলগুলোর মধ্যে এটি একটা ... ভাঁড় গোছের চরিত্রকে দিয়ে ভাড়ামি করাতে হলে তাকে স্টেরিওটাইপড করে ফেলা যায়, আর যে গোষ্ঠীর মধ্যে ফেলা, তাদের দুর্নাম যেকারণে, তা দেখিয়ে দর্শকদের (যারা আবার ঐ গোত্রে পড়েনা) বিস্তর আমোদ দেয়া চলে।

বাংলা নাটকে এই রকম স্টেরিওটাইপের ছড়াছড়ি। আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যেসব নাটক হতো, তার নাট্যকারেরা উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গ থেকে আসতেন বলে মনে হয় (হয়তোবা আমিও এখানে স্টেরিওটাইপে ফেলছি তাদের)। সেজন্য অধিকাংশ নাটকেই কমিক রিলিফ চরিত্রটি হতো নোয়াখালী বা চট্টগ্রামের, অবোধ্য অমার্জিত শব্দ চয়নে যাদের বিমল আনন্দ। নাটকের ঘটক হবে গোলটুপী পরা, বাম গালে একটা বড় আঁচিল থাকবে, হাতে একটা ছাতা। আদিবাসী কাউকে দেখাতে হলে তার নাম হবে মলুয়া, কথা বলবে “বটেক”, “বাবু”, “হামি” এরকম ভাষাতে। গ্রামবাসী নায়ক নায়িকার মা কথা বলবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রংপুরের ভাষাতে, অথবা নিতান্তই “শুদ্ধ” ভাষাতে। মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রটি হবে হতদরিদ্র, এবং অধুনা-ক্ষমতাধর-পূর্বে রাজাকার মোড়লের হাতে নিগৃহীত। নাটক থেকে সিনেমাতেও আসবে এসব স্টেরিওটাইপ, নায়িকার বড়লোক বাবার নাম হবে অবধারিত ভাবে “চৌধুরী সাহেব”, বাড়ির ভেতরে পরবেন ড্রেসিং গাউন, ধুমপানের পাইপ হাতে সিঁড়ি বেয়ে নামবেন। নায়ক গরীব কিন্তু শিক্ষিত হলে নির্ঘাত হবে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। বাংলা নাট্যকারদের দোষ দেই কীভাবে, স্বয়ং শেক্সপিয়ারের নাটকে স্টেরিওটাইপের ছড়াছড়ি ... ইহুদি শাইলক হয় ভিলেন, চার্লস ডিকেন্সের অলিভার টুইস্টের ঘৃণ্য ভিলেন ফ্যাগিনকেও দেখানো হয়েছে ইহুদি। সেরকম হালের মারদাঙ্গা টাইপের হলিউডী ছবিতে ভিলেনটা হয় আরব মুসলমান।

নাটক-সিনেমা থেকে বাস্তবতার মধ্যেও একই দশা। হিন্দু হলেই ধরে নেয়া হবে, ব্যাটা একটু পরেই সব কিছু পাচার করে দেবে ভারতে, অথবা আওয়ামী লীগের সমর্থক হবে। কারো মাথায় টুপি থাকলে, বা মুঠোখানেক দাড়ি থাকলে সন্দেহ হবে, জামাত-শিবির কি না। চারুকলা কিংবা স্থাপত্যের ছাত্রদের হতে হবে লম্বা এলোমেলো চুলের সিগারেট ফোঁকা চেহারা, আর বুয়েটের প্রকৌশলবিদ্যার কারিগরেরা হবে চশমাপরা নিরীহ চেহারার বিশিষ্ট আঁতেল। বুদ্ধিজীবীরা হবে ফতুয়া বা পাঞ্জাবী পরা, কাঁধে শাল। সাফারি সুট কিংবা মুজিব কোটে বেরিয়ে আসবে রাজনৈতিক পরিচয়।

এহেন মানসিকতা অব্যাহত থাকবে দেশের বাইরে এলেও। কৃষ্ণাঙ্গ দেখলেই সন্দেহ হবে, ছিনতাই করবে নির্ঘাত এখনই। (আমার এক বাঙালি বন্ধু এই সমস্যাতে পড়ে প্রায়ই ... হুডতোলা জ্যাকেট পরে ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে সন্ধ্যায় হেঁটে গেলে নাকি উলটো দিক থেকে আসা ছেলে মেয়েরা সবাই ভয় পেয়ে রাস্তা পেরিয়ে অন্য দিকে হাঁটে)।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় বা পাকিস্তানীদের স্টেরিওটাইপ কিছুদিন আগে পর্যন্তও ছিলো মুদী দোকানদার হিসাবে ... ইদানিং অবশ্য গাদায় গাদায় দক্ষিণ এশীয় প্রকৌশলীদের দেখে সেটা কমেছে। ভিলেনের স্টেরিওটাইপের ব্যাপারটা কালে কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালটে গেছে ... বর্ণবাদের আমলে ভিলেন হতো কৃষ্ণাঙ্গরা ... তাদের “পাশবিকতা” দেখানো হতো, আর শ্বেতাঙ্গ নায়ক অসহায় নায়িকাকে উদ্ধার করতো এই কৃষ্ণাঙ্গ ভিলেনের কবল থেকে। বিংশ শতকের শুরুতে ইতালীয়দের অভিবাসন বেড়ে যায়, আর দরিদ্র ইতালীয় অভিবাসীরা অনেক শ্বেতাঙ্গ মার্কিনীর কাজ আরো কম বেতনে করে হাতিয়ে নেয়। ফলে সে সময়কার গল্প নাটকে সিনেমাতে ভিলেনের স্টেরিওটাইপে এসে পড়ে ইতালীয়রা। ইহুদীবিদ্বেষ অব্যাহত থাকায় ধনী ভিলেন দেখানো হতো এই ধর্মাবলম্বী কাউকে। সত্তরের দশকের শেষ থেকে আশির দশক জুড়ে জাপানি ব্যবসায়ীরা নবলব্ধ বিত্তে কিনতে থাকে আমেরিকার সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এ সময়ের এশীয়-বিরোধী স্টেরিওটাইপিংটাও লক্ষ্যনীয়। গল্প সিনেমাতে এশীয় পুরুষ হলেই হতো গ্যাংস্টার, ধুর্ত ব্যবসায়ী, কিংবা বেকুব গোছের বোকাসোকা দোকানদার – মূল নায়কের সাথে ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বোল বলে হাসির পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই তার কাজ।

অবশ্য স্টেরিওটাইপ নিয়ে মস্করাও কম করা হয় না টিভি/সিনেমাতে। জনপ্রিয় মার্কিন কার্টুন দ্য সিম্পসন্সের সবগুলো চরিত্রই ইচ্ছাকৃতভাবে চরম স্টেরিওটাইপড। ভারতীয় মুদী-দোকানী অপু, কুটকৌশলী ব্যবসায়ী মিস্টার বার্ন্স, হোমার সিম্পসন নিজেই – সবই বিভিন্ন স্টেরিওটাইপ, আর ইচ্ছা করেই তাদের বিভিন্ন আচরণ দেখিয়ে স্টেরিওটাইপিংকেই মস্করা করা হয়। একই ব্যাপার দেখি আরেক জনপ্রিয় কার্টুন “ফ্যামিলি গাই”-তে, সবাই সেখানে স্টেরিওটাইপড, সবার কাজই স্টেরিওটাইপ অনুসারে।

স্টেরিওটাইপিং নিয়ে যতই আলোচনা করা হোক না কেনো, হয়তো এটা থেকে বেরুনো সম্ভব না আমাদের কারো পক্ষেই। অনেক চিন্তা করে যা মনে হয়, এটা মানুষের অবচেতনে প্রোথিত একটা ব্যাপার – সেই আদিম কালে মানুষ যখন প্রকৃতি আর অন্য প্রাণীদের সাথে সংগ্রামে ব্যস্ত, তখন তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হতো এক মুহুর্তেই যে, সামনে যা এসেছে তা শত্রু না মিত্র। আর সেই ক্ষণিক-সিদ্ধান্ত নিতে হলে চেহারা দেখে আন্দাজ করাটাই একমাত্র কৌশল ... আচরণ-বিচার করার সময় কোথায়।

পূর্বপুরুষদের সেই প্রবৃত্তি আজও হয়তো রয়েছে আমাদের মনের গহীনে, তাই দেখামাত্র কাউকে ফেলে দেই স্টেরিওটাইপে, লেবেল লাগিয়ে দেই ইচ্ছে মতো। হয়তো এই প্রবৃত্তির কবল থেকে মুক্তি নেই আমাদের, যতোই চেষ্টা কসরত করি না কেনো।

হয়তোবা এ আমাদের মানবিক সীমাবদ্ধতা।

Tuesday, March 18, 2008

২০০১ কিংবা ২০০৮/ অডিসির স্বপ্নদ্রষ্টার প্রস্থান


"The truth, as always, will be far stranger."



আর্থার সি ক্লার্কের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে সেই স্কুলে থাকার সময়ে। সেবা প্রকাশনীর কল্যাণে ঝরঝরে অনুবাদে "সন্ধানী" বইটা পড়েছিলাম, লাগামহীন কল্পনার জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম মুহুর্তেই। অনেক পরে আসল বইটা, আর্থার সি ক্লার্কের "২০০১ - এ স্পেস অডিসি" পড়ি, দেখি স্ট্যানলি কুব্রিকের হাতে তৈরী সিনেমাটিও। কিন্তু সন্ধানী আমাকে হঠাৎ করে বানিয়ে দেয় সাইন্স ফিকশনের চরম ভক্ত। ক্লাস নাইনে থাকার সময়ে পাড়ার এক ভাইয়ের কাছে ২০১0 - অডিসি ২ পেয়ে যাই, গোগ্রাসে গিলি পরের গল্পকথা। লালদিঘির পাশের ব্রিটিশ কাউন্সিলে আমার বড়বোনের কার্ড দেখিয়ে সিরিজের বাকি বইগুলোও একে একে পড়া হয়ে যায়।

আর্থার সি ক্লার্কের জন্ম ইংল্যান্ডের সমারসেটে, ১৯১৭ সালে। অভাবের তাড়নায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেননি শুরুতে, শিক্ষাবিভাগে অডিটরের চাকুরি নেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে রয়াল এয়ারফোর্সে রেডার বিশেষজ্ঞ হিসাবে কাজ করেন। যুদ্ধ শেষে লন্ডনের খ্যাতনামা কিংস কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যা ও গণিতে প্রথম শ্রেণীর ডিগ্রি পান।

লেখালেখির শুরু করেন ১৯৪৬ থেকে। ১৯৪৮ সালে লিখেন দি সেন্টিনেল নামের গল্পটি, যা পরে রূপ নেয় ২০০১ - এ স্পেস অডিসি উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে।

এই গল্পটিতেই ক্লার্কের লেখনীর মূল ধারাটির আভাস পাওয়া যায়। পৃথিবীর মানব সভ্যতার সাথে অনেক শক্তিমান ও সুপ্রাচীন অপার্থিব সভ্যতার মোলাকাত ও তার পরিণাম নিয়ে ক্লার্ক লিখেছেন অধিকাংশ উপন্যাস। ক্লার্কের সেই ভবিষ্যত অবশ্য অন্ধকার বা ভীতিকর না, বরং মানবিকতায়, আশাবাদে পরিপূর্ণ সেই অনাগত দিনগুলো।

১৯৫৬ সাল থেকে ক্লার্ক শ্রীলংকাতে বসবাস শুরু করেন। স্কুবা ডাইভিং শখ ছিলো ... সমূদ্রের অমোঘ আহবানে তাই রয়ে যান আজীবন শ্রীলংকার কলম্বোতে।

সাইন্স ফিকশন ছাড়াও ক্লার্কের কল্পনাশক্তির কাছে আমরা, মানে এই ডিজিটাল দুনিয়া প্রচন্ডভাবে ঋণী। বিশ্বাস না হতে পারে, কিন্তু এই ক্লার্কই প্রথম ১৯৪৫ সালে যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবহারের ধারনা দেন। ব্রিটিশ ইন্টারপ্ল্যানেটারি সোসাইটির একটি জার্নালে, এবং পরে ওয়ারলেস ওয়ার্ল্ড নামের সাময়িকিতে ক্লার্ক দেখান, মাত্র তিনটি কৃত্রিম উপগ্রহ দিয়েই সারা বিশ্বের সর্বত্র টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা সম্ভব।

ক্লার্কের ভবিষ্যত-দর্শন এখানেই থেমে থাকেনি। হালের জনপ্রিয় ধারণা, স্পেস এলিভেটর, এটাও জনমানুষের কাছে এসেছে ক্লার্কের উপন্যাস ফাউন্টেইন্স অফ স্পেস-এ। যদিও ধারণাটি নিয়ে আগে কিছু বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী আলোচনা করেছেন, জনপ্রিয় সাহিত্যে এর প্রথম উপস্থাপনা ঘটে এই উপন্যাসে।

কৈশোরে আমার কাছে মহাবিশ্বের দুয়ার খুলে দেয়া সেই আর্থার সি ক্লার্ক আজ মারা গেছেন, শ্রীলংকার কলম্বোতে, ৯১ বছর বয়সে। ক্লার্কের এই মহাপ্রয়াণে নিবেদন করছি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

শেষ করছি ক্লার্কের কিছু বাণী দিয়ে।

  • Perhaps it is better to be un-sane and happy, than sane and un-happy. But it is the best of all to be sane and happy. Whether our descendants can achieve that goal will be the greatest challenge of the future. Indeed, it may well decide whether we have any future.
  • The Information Age offers much to mankind, and I would like to think that we will rise to the challenges it presents. But it is vital to remember that information — in the sense of raw data — is not knowledge, that knowledge is not wisdom, and that wisdom is not foresight. But information is the first essential step to all of these.
  • The greatest tragedy in mankind's entire history may be the hijacking of morality by religion.
  • It is not easy to see how the more extreme forms of nationalism can long survive when men have seen the Earth in its true perspective as a single small globe against the stars.
  • ক্লার্কের সূত্র

  • Clarke's First Law: When a distinguished but elderly scientist states that something is possible, he is almost certainly right. When he states that something is impossible, he is very probably wrong.
  • Clarke's Second Law: The only way of discovering the limits of the possible is to venture a little way past them into the impossible.
  • Clarke's Third Law: Any sufficiently advanced technology is indistinguishable from magic

    ----

  • SETI is probably the most important quest of our time, and it amazes me that governments and corporations are not supporting it sufficiently.

    ------