Wednesday, February 6, 2008

কম্পিউটার নিরাপত্তার পাঠ - Denial of Service attack বা সেবা-বিঘ্নকারী আক্রমণ

ডেনাইয়াল অফ সার্ভিস অ্যাটাক বা সেবা-বিঘ্নকরণ আক্রমণ হলো কোনো কম্পিউটার সিস্টেমের কোনো রিসোর্স বা সেবার (service) প্রকৃত ব্যবহারকারীদের বাধা দেয়ার একটি কৌশল। কোনো কম্পিউটার সিস্টেম বা ইন্টারনেট ওয়েবসাইটে এই আক্রমণ চালানোর মাধ্যমে ঐ সিস্টেম বা সাইটের যথাযথ কার্যক্রমকে ধীর গতির, বা অনেক ক্ষেত্রে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়।


এই আক্রমণ চালানোর একটা বেশ জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো বাইরে থেকে ঐ সিস্টেম বা সাইটের সাথে যোগাযোগের জন্য অসংখ্য বার্তা পাঠাতে থাকা। একটি বার্তা বিশ্লেষণ করতে করতে আরো বেশ কয়টি বার্তা যদি এসে পড়ে, তখন ঐ সিস্টেমটি আক্রমণকারীর পাঠানো বার্তা বিশ্লেষণেই ব্যস্ত থাকে, এবং প্রকৃত ব্যবহারকারীরা ধীর গতির সম্মুখীন হন।


ডেনাইয়াল অফ সার্ভিস আক্রমণের প্রধান দুটি মাধ্যম হলো

* টার্গেট করা কম্পিউটারকে রিসেট করে দেয়া, অথবা তার সীমিত রিসোর্সগুলোকে ব্যবহার করে অন্যদের ব্যবহারের অযোগ্য করে ফেলা

* আক্রমণের লক্ষ্য যে সিস্টেম বা সাইট, তার সাথে প্রকৃত ব্যবহারকারীদের যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধ করে দেয়া।


উদাহরণ

ধরা যাক, করিমের একটি সাইট আছে যার নাম কখগ ডট কম। এই ওয়েবসাইটটি যে খানে হোস্ট করা হয়েছে, সেখানে দৈনিক ১ গিগাবাইট ব্যান্ডউইডথ কেনা আছে। দিনে ১০ হাজার হিট হয় এই সাইটে, এবং ৪০০ মেগাবাইটের বেশি ব্যান্ড উইডথ দরকার হয় না। এখন এই ওয়েবসাইটকে আক্রমনকারী শত্রু শওকত একটি স্ক্রিপ্ট লিখে ঐ সাইটে অজস্র ভুয়া হিট করতে থাকলো, ফলে এক ঘণ্টারও কম সময়ে ২৫০০০ হিট করে ১ গিগাবাইট সীমা অতিক্রম করে ফেলা হলো। এখন ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীদের কেউই আর ঐ সাইটে যেতে পারবেন না।


ধরা যাক, করিম এবার আক্রমণ ঠেকানোর জন্য অসীম ব্যান্ডউইডথের ব্যবস্থা করলেন, এবং শওকতের কম্পিউটারের আইপি অ্যাড্রেস নিষিদ্ধ করে দিলেন। এবার শওকত ভিন্ন পদ্ধতিতে আগালেন ... সরাসরি আক্রমণ করার বদলে "স্মার্ফ অ্যাটাক" (Smurf attack) নামের আক্রমণ করলেন। এই আক্রমণের সময়ে শওকত সরাসরি করিমের কম্পিউটারে আক্রমণ না করে ইন্টারনেটে হাজার হাজার সাইটে ping মেসেজ পাঠালেন। (সংযোগ ঠিক আছে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য ping ব্যবহৃত হয়। এই মেসেজ কোনো কম্পিউটারে পাঠালে ঐ কম্পিউটার মেসেজের জবাবে আরেকটি মেসেজ প্রেরক কম্পিউটারে পাঠায়)। তবে শওকত পিং পাঠানোর আগে কারসাজি করে মেসেজের প্রেরকের নাম পালটে দিলেন, অর্থাৎ প্রেরকের ঠিকানার অংশে নিজের কম্পিউটারের আইপির বদলে করিমের সাইটের আইপি দিয়ে দিলেন। ফলে হাজার হাজার সাইট যখন এই পিং বার্তার জবাব দিবে, তখন সেই জবাব গুলো চলে যাবে করিমের কম্পিউটারে। একই সময়ে আসা এই হাজার হাজার বার্তা গ্রহণ করতে করতে করিমের কম্পিউটার আসল গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগ করার সময় পাবে না। ফলে ওয়েবসাইটটিতে যারা ঢুকতে যাবেন, তাঁরা ব্যর্থ হবেন।

(কম্পিউটারের জগতের বাইরেও এরকম আক্রমণ চালানো যায়। যেমন ধরাযাক খবিরের মোবাইল ফোনে গনেশ ফোন করতে পারে, তা শওকত চায় না। তাই ফোন ঠেকানোর জন্য অনবরত খবিরকে মিস কল দিতে থাকলো। লাইন ব্যস্ত থাকায় খবিরকে আর গনেশ ফোনে পেলো না। এটাও সেবা-বিঘ্নকরণ আক্রমণের একটা বাস্তব উদাহরণ।)

(বিস্তারিত জানতে ইংরেজি উইকিপিডিয়ার নিবন্ধ দেখুন)।

Friday, February 1, 2008

ছোট গল্প

গভীর অরণ্য।



দুটি মানুষ ও একটি বাঘ।




একটি মানুষ ও একটি বাঘ।



একটি বাঘ।



(লেখক আমি নই, বহু আগে কোথাও পড়েছিলাম। গল্প কতো ছোট হতে পারে, তার উদাহরণ।)

মামু কাহিনী



মামু, অর্থাৎ আইন-শৃংখলা রক্ষী পুলিশ বাহিনীর সম্পর্কে বাঙালি হওয়ার সুবাদে মনে মনে একটা ভীতি জন্মগত ভাবেই প্রোথিত হয়ে গেছে ... তাই নীল-জামা, কালো-জামা দেখলেই একটু আঁতকে উঠে ভিজা বিড়াল সেজে রই। এহেন এই মামুর সংস্পর্শে দেশে পড়তে হয়নি বেশি, একবার এরশাদ মিঞার লটবহরের গার্ডের তাড়া খাওয়া বাদে।

তবে চোরের দশদিন, গৃহস্তের/মামুর শেষদিন। কপালে সেই মামুদের মুখোমুখি হওয়া লেখা ছিলো, বিদেশ বিভুঁইয়ে এসেই তা হতে হলো। তাও আবার পিস্তল হাতে রীতিমত ধাওয়া।

নাহ, ভিজা বেড়ালের মতো শান্ত-শিষ্ট লেজ-বিশিষ্ট এখানেও আমি, তবে ধাওয়া খাওয়ার কাহিনীটাও বিচিত্র। সদ্য দেশ থেকে এসে তখন ক্যাম্পাসের মধ্যে এক দেশী আর এক পাকির সাথে বাসা ভাড়া নিয়েছি। গাড়ি-টাড়ি কিছুই নাই, চলা ফেরার জন্য কিনলাম এক সাইকেল। কিন্তু যেই বান্দার কাছ থেকে কেনা, আমাকে আবুল পেয়ে ধরিয়ে দিলো এক রদ্দি মার্কা মাউন্টেইন বাইক। মাস দুয়েকের মধ্যে চাকার টিউবের রফাদফা।

দেশে থাকতেও আমার সাইকেল ছিলো, কিন্তু দেশের মতো মোড়ে মোড়ে তো আর সাইকেলের চাকা মেরামতের দোকান আর ৫টাকায় পাংচার মেরামত করা পিচ্চি নাই। নিজে মেরামত করতে গিয়ে ধরা খেয়ে তাই বিরক্ত হয়ে পেছনের চাকাটা খুলে নিয়ে মাইলখানেক হেঁটে সাইকেল বিক্রির দোকানে নিয়ে ঠিক করালাম।

মার্চ মাস ... স্প্রিং ব্রেক এর বন্ধ ... ক্যাম্পাসের সব চ্যাংড়া পোলাপাইন ফুর্তি করতে বীচ টাইপের জায়গায় কেটে পড়েছে। বিদেশ থেকে আসা "খ্যাত" গ্র্যাড স্টুডেন্টরাই পড়ে আছে ... সেই তালিকায় নাম লেখানো আমি চাকা ঘাড়ে করে বাসায় ফিরে, অ্যাপার্টমেন্টের বাইরের রাস্তায় বসে সাইকেলে চাকা ফিট করা শুরু করলাম। খোলা যতটা সহজ, লাগানো ততোটা না, তাই প্লায়ার্স আর রেঞ্চ হাতে প্যাঁচ দিতে দিতে নাভিশ্বাস উঠার দশা।

এমন করে চাকায় প্যাঁচ মারতে কখন আমি ব্যস্ত, সামনে কার যেনো ছায়া পড়লো। ফিরে তাকিয়ে তো হার্টফেলের দশা ... রীতিমতো পিস্তল হাতে RAB স্টাইলে পোজ মেরে এক কালো-পোষাকের বিশালদেহী মামু দাঁড়িয়ে। বাজখাই কণ্ঠে আমাকে জিজ্ঞেস করে, "এই, তুমি কী করো?"

এমনিতেই মামুকে ভয়, তায় আবার পিস্তল হাতে! কাপড় চোপড় নষ্ট হয়নি, কিন্তু খাবি খাওয়ার জোগাড়। আজ অবধি ইংরেজি বলি প্রথমে বাংলাতে বাক্য বানিয়ে তারপরে ট্রান্সলেট করে। পিস্তলের মুখে তো আর তা সহজে হয়না ... আমতা আমতা করতে করতে মুখ থেকে সাইকেল মেরামতি সংক্রান্ত জগাখিচুড়ি কিছু বেরুলো বলে টের পেলাম। আমার অশ্বেতাঙ্গ চেহারা, আর মার্চ মাসের অল্প শীতেও বঙ্গের বিশাল জ্যাকেট গায়ে জবুথবু হয়ে থাকা দেখে মামুর সন্দেহ আরো বাড়লো। ক্যাম্পাস আবার সাইকেল চোরের আড্ডা খানা। পরিচিত সবারই সাইকেল চুরি একবার হলেও গেছে। ব্যাটা তাই পিস্তল আরো বাগিয়ে ধরে প্রশ্ন করলো, "কই থাকো তুমি?"

পাশের অ্যাপার্টমেন্টটা দেখিয়ে কাজ হলোনা ... আর গোদের উপরে বিষফোড়ার মতো আমার দুই রুমমেটও ঐ সময় বাসার বাইরে ... আমার কাছে চাবিও নাই। ভাগ্য ভালো, দিন দুয়েক আগেই ঠিকানা সহ স্টেট আইডি বানিয়ে এনেছিলাম। গ্রীজমাখা হাতে তড়ি ঘড়ি করে মানিব্যাগ খুলে ওটাই বাড়িয়ে ধরলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক দেখে মামু ব্যাটা একটু আশ্বস্ত হলো, আমি পাশের অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা।

পিস্তলটা নেমে আসলো, আর দেখি, মামু ওয়াকি টকি বের করে বলে, "Cancel the alert, I don't need backup" !!!! মানে আমার জাব্বা জোব্বা অশ্বেতাঙ্গ চেহারা আর হাতে রেঞ্চ দেখে মামু আমাকে শহরের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বা নিদেনপক্ষে সাইকেল-চোর পার্টির নেতা বলে মনে করেছিলো, আর গোটা কয়েক মামু-গাড়ি ডেকে ফেলেছিলো কাছে আসার আগে!

যাওয়ার সময় মামু রীতিমত ঝাড়ি দিয়ে গেলো, spring break এর সময়ে বীচে মাস্তি না করে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে আছি কেনো, এই ব্যাপারে। নাকে খত দিয়ে আমিও প্রায় মুচলেকা দিলাম, আর সাইকেল মেরামতির কাজে নামবোনা ... দরকার হলে ঘাড়ে করে নিয়ে যাবো দোকানে।



পরের সপ্তাহেই আবারো মামু দর্শন হলো, তবে সে আরেক কাহিনী। এও ঐ সাইকেল নিয়েই। সাইকেল-চোর-চক্রকে ধরার জন্য মামু পিস্তল নিয়ে টহল দিচ্ছে এলাকাতে, আগের সপ্তাহে হাতে নাতে তার প্রমাণ পেয়ে আমি বিগলিত, তাই সাইকেলের ইউলকের বদলে কেবল লক (তারের) দিয়ে বাড়ির খুঁটিতে বাইরে বেঁধে রেখেছিলাম। দু'দিনের মাথায় সাইকেল গায়েব! এবার মামু ডাকার পালা আমার ... কোনোদিন আর সাইকেলের দেখা পাবো না যেনেও মনের কষ্টে মামুর কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে বিশাল এক রিপোর্ট লিখালাম। এক "মামী" এসে সরেজমিন তদন্তও করে গেলো, আর জানালো, ক্যাম্পাসে কোথাও সাইকেলটা দেখতে পেলেই যাতে মামু ডাকি। ওরা আবার RAB এর মতো তৎপর না ... বিষ্ণুমুর্তির মতো নিজে থেকে কিছু খুঁজে নাকি দেখাটা ওদের কাজ না।



একই সপ্তাহে হলো দুইবার মামু দর্শন, আর ঘটনার কেন্দ্রে থাকা সেই সাইকেলটার বিদায়। এর পরেও একবার মামু দর্শন হয়েছে, অবশ্য তা হাইওয়েতে টিকেট দিয়ে কমিশন পাওয়ার আনন্দে উদ্বেল ছোট শহরের মামুর সাথে। বেকুব চেহারা করে সদ্য আম্রিকা আগত ভাব দেখিয়ে ঐবার নিস্তার পেয়েছি। সাইকেল এখন কঠিন মোটা ইউলকে বেঁধে রাখি, আর রাডার ডিটেক্টর দিয়ে মামুর শনি দৃষ্টি খেয়াল করে রাস্তায় চলি। হাজার হোক, মামু বলে কথা ...

লাইব্রেরি কথন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসার পরে এখানকার মানুষের লাইব্রেরি প্রীতি দেখে বেশ মুগ্ধ হই। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা যমজ শহর শ্যাম্পেইন ও আরবানাতে লাইব্রেরি অনেকগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে এক কোটির উপরে বই আছে (বাংলা বইও আছে বেশ কিছু)। এসব বাদেও রয়েছে প্রতিটি শহরের নিজস্ব লাইব্রেরি, আর সেগুলোতে পাঠকের ভীড়ও যথেষ্ট।

এদেশে আসার শুরু থেকেই লাইব্রেরিতে আমিও ঘাঁটি গেড়ে বসেছি। বুয়েটে পড়ার সময় লাইব্রেরি থেকে কাজের বই নিতাম খুব কম - বেশি নিতাম ডানদিকের ধুলো পড়া দেয়াল ঘেঁষে থাকা অ-পাঠ্যপুস্তক এলাকার বই। বুয়েটে ইদানিং আর পাঠ্যবই বাদে অন্য কিচ্ছু কেনা হয় না, কিন্তু ষাটের দশকে মার্কিন দাতব্য সংস্থা বই পাঠিয়েছিলো প্রচুর , দান করা সেই বইয়ের মধ্যে সাহিত্য, গল্প, কবিতা, এরকম অনেক কিছুই ছিলো।

বুয়েটের ছাত্রদের আঁতেল বলে অপবাদ রয়েছে, "আউট বই" (সেকেলে ভাষায় ...) পড়ে সময় নষ্ট করার চাইতে বরং চোথাবাজি টাইপের বা সার্কিট সলিউশন ধরনের শম সিরিজের বইতেই আগ্রহ বেশি। তাই ধুলো জমতে থাকে ঐ শেলফে, বছর বছরে প্রচুর ধুলো। আমি ঐ দিকটায় যাতায়াত শুরু করি ৯৯ সাল থেকে, অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, অনেক বই সেই ষাটের দশক থেকে আজ অবধি কেউ ধরে দেখেনি।

এর পর থেকে ঐ জায়গাটা আমার খুব প্রিয় হয়ে পড়ে। লাইব্রেরিতে যেতাম ঐখানে ঘুরাঘুরি করার জন্য, আর কোনো ইন্টারেস্টিং বই পাওয়ার জন্য। উচ্চমার্গীয় সাহিত্য অবশ্য আমার মিস্তিরি-মাথার উপর দিয়ে যায়, কিন্তু ওখানে আমার ইন্টারেস্ট সাইন্স ফিকশন, আর ইংরেজি ছোটগল্পের প্রচুর বই ছিলো। "ও হেনরি"র গল্প গুচ্ছ (মনে আছে, সেই "ডেলা অ্যান্ড জিম" এর কাহিনী?) ওখানে পেয়েছি, আরো পেয়েছি হালের জুরাসিক পার্কের লেখক মাইকেল ক্রিকটনের শুরুর দিকে লেখা বই "অ্যান্ড্রোমিডা স্ট্রেইন"। আর শার্লক হোমস? তার সমগ্র পেয়েছিলাম ... পুরাটা ঘেঁটে ফেলেছি।

শেষের দিকে ঐ তাকের সব বই পড়া হয়ে গিয়েছিলো, অধিকাংশই পুরো ৩০ বা ৪০ বছরে আমিই একমাত্র ইস্যু করেছি ... এমন। বইগুলো নেয়ার সময় লাইব্রেরিয়ান অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাতো আমার দিকে, আজব চিড়িয়া দেখছে, এরকম চাহনীতে। আসে পাশের বিশাল আঁতেল বাহিনী আর বয়েলস্টেডের ইলেক্ট্রনিক্স বইয়ের মাঝে নাক গুঁজে থাকা ছাত্রদের মধ্যে গল্পের বই ইস্যু করতে দেখলে হয়তো চিড়িয়া মনে করাটাই স্বাভাবিক। হাজার হলেও বাঙালি তো, বাধ্য না হলে বই পড়ানো আমাদের কঠিন ... (মুজতবা আলীর লেখাটা হাঁড়ে হাঁড়ে সত্যি)।

গুগল কথন ৬ - প্রযুক্তির স্রোতে অবগাহন (সমাপ্ত)

গুগলপ্লেক্সের প্রধান ক্যাফেতে প্রতিদিন দুপুরে বা বিকেলে যেতাম ... ওখানকার ৫ রকমের বিভিন্নদেশী খাবারের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। এই ক্যাফেটার নাম "চার্লি'স ক্যাফে" ... জানতে চেয়েছিলাম একদিন, চার্লিটা কে? জানলাম, চার্লি ছিলো গুগলের প্রথম বাবুর্চি। যখন গুগলের মোট কর্মী সংখ্যা দশ বিশ জন, তখন যোগ দেয়া চার্লি বেতনের বদলে গুগলের কিছু শেয়ার পেয়েছিলো। যখন স্টক মার্কেটে গুগল শেয়ার ছাড়লো বছর কয়েক আগে, ততদিনে সেই সব শেয়ারের দাম হয়েছে কয়েক মিলিয়ন ডলার। সেই মিলিয়নিয়ার চার্লি আজ গুগল থেকে অবসর নিয়ে নিজের রেস্তোঁরা খুলতে পেরেছে, কিন্তু তার নাম রয়ে গেছে।

গুগলে কাজের পালা শেষ হয় আগস্ট মাসের মাঝামাঝি। তিনটা চমৎকার মাস সেখানে কাটাবার পর বুঝতে চেষ্টা করলাম, কেনো গুগল এতো প্রচন্ড সফল হয়েছে দুনিয়ার সেরা সব প্রোগ্রামারদের আকর্ষণ করতে। শুধু তিনবেলা মজাদার খাবার নিশ্চয় এর কারণ না ... অথবা গুগলের মহামূল্যবান শেয়ার/স্টকও প্রধান কারণ হতে পারে না। সিলিকন ভ্যালির অনেক কোম্পানিরই স্টক/শেয়ারের দাম তর তর করে বাড়ে। তাহলে ব্যাপারটা কী?

ভেবে চিন্তে যেটা মনে হলো, গুগলের প্রধান সাফল্যের পেছনে রয়েছে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, আর কর্মীদের কাজ করার অশেষ স্বাধীনতা দেয়া। এখানে সবাই সপ্তাহে একটা পুরো দিন পায় নিজের ইচ্ছা মতো কোনো কিছু নিয়ে কাজ করার। সেটা গুগলের কাজে আসুক বা না আসুক, কোনো সমস্যা নেই। এমনকি অন্য কাজের ডেডলাইন থাকলেও সপ্তাহে ঐ এক দিন সবাই পাবেই। আরো দেখেছি, পারস্পরিক সম্মান দেয়া। দেশে থাকতে দেখতাম, কোম্পানির মালিক তো বটেই, অফিসের বড়কর্তা তাদের অধীনস্ত সবাইকে "তুমি" বলে সম্বোধন করছে, আর অন্য সবাই বড়কর্তাদের হুজুর-সালাম দিয়ে চলেছে। কিন্তু গুগলে যেদিন ক্যাফের সাধারণ কর্মীদের খাবার লাইনে আমার ঠিক সামনে গুগলের প্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিনকে অন্য সবার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, তখন বুঝলাম এখানে পদমর্যাদার জোর খাটানো নেই। অফিসে গ্রুপের মিটিং থেকে শুরু করে সর্বত্র এটা অনুভব করেছি ... তিন মাসের জন্য আসা শিক্ষানবিশ ইন্টার্ন বলে আমার মতামতকে কেউ অবজ্ঞা করেনি, বরং যুক্তিসঙ্গত মতামত, অভিমত - এসব সবাই যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে নিয়েছে।


কর্মীদের অজস্র সুবিধা দেয়া, তিনবেলা রাজভোগ খাওয়ানো, কনফারেন্স বাইকে আড্ডা - এসবের মাধ্যমে মানুষ অফিসে বসে থাকছে সারাদিন, তা সত্যি, কিন্তু আসল কাজের উদ্দীপনা আসছে কাজের পরিবেশ, আর নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে দেয়ার সুযোগ পাওয়ার মধ্য দিয়ে। আর সেই সাথে মজা করার অসংখ্য সুযোগ তো আছেই ... দুই দিন পর পরই অফিসের সবাই হই চই করে ঘুরে বেড়াতো বিভিন্ন স্থানে। আমার এই তিন মাসের মধ্যেই ৪টা অফিস পিকনিক হয়েছে ... আর অন্য সময় একেবারে স্কি-করার ট্রিপ থেকে শুরু করে আরো অনেক চমৎকার অফ-সাইট ট্রিপ হয়ে থাকে। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারের কোম্পানি মিটিং এর কথা আগেই বলেছি ... সেটাও এক বিশাল পার্টি। আর গুগলে কাজ করে নানা দেশের নানা ধর্মের লোকজন ... সবার জন্যেই সব রকম ব্যবস্থা রয়েছে। চীনা আর কোরীয় খাবারের উপরে আলাদা আলাদা একটা করে ক্যাফে তো আছেই, আর সেই সাথে বিভিন্ন উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন হয় মূল ক্যাফেতেও। আমি থাকার সময় ভারতের ৬০তম জাতীয় দিবস উপলক্ষে চার্লি'স ক্যাফেতে বিশাল খাবার দাবারের আয়োজন হলো। আবার শুক্রবারে মুসলমান কর্মীদের জন্য বিশেষ হালাল খাবারের ব্যবস্থা দেখেছি। শুনেছি, রমজান মাসে ক্যাফে গুলোতে ইফতারের ব্যবস্থাও করা হয় মুসলমানদের জন্য।

গুগলের কর্মী সংখ্যা আজ ছাড়িয়ে গেছে ১০ হাজারের উপরে। তবে একটু মন খারাপ হলো এটা ভেবে, শিশির, সবুর, আর অল্প দুই-একজন ছাড়া এখানে বাংলাদেশী কর্মী নেই বললেই চলে। অথচ বাংলাদেশে প্রতিভার অভাব নেই। যে কয়দিন কাজ করেছি, মনে হয়েছে, এখানে কাজ করার মতো যোগ্যতা বাংলাদেশের অনেক প্রতিভাবান প্রোগ্রামারের রয়েছে। আমি আশাবাদী ... ভবিষ্যতে, বছর কয়েক পরেই গুগলে বাংলাদেশের আরো অনেক প্রাণবন্ত মুখের আবির্ভাব ঘটবে। ভারতের বাঙ্গালোর, দিল্লী, আর হায়দরাবাদের মতো বাংলাদেশেও গুগলের গবেষণাকেন্দ্র স্থাপিত হবে।

---

অনেক মজার, অনেক স্মৃতির শেষে গুগলে কাজের পালা শেষ হলো আমার আগস্টের ১৭ তারিখে। শেষের দুই তিন দিন আমাদের বিদায়ী অনুষ্ঠানে কেটে গেলো, আমার হোস্ট রিচার্ড আর ব্রায়ানের সাথে পুরো অফিসের সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া হলো বিভিন্ন স্থানে। একেবারে শেষ দিনে গুগলপ্লেক্সকে বিদায় জানাতে বেশ খারাপ লাগছিলো। তবু জীবনের গান চলতেই থাকে, ঘুরতে থাকে প্রযুক্তির স্রোতে গুগলের কর্মীদের অবগাহন, এগিয়ে চলে পৃথিবী।