Thursday, October 16, 2008

বাকের ভাইয়ের একদিন ...

"কোথাও কেউ নেই" নাটকটি নব্বইয়ের দশকের বাংলাদেশে অর্জন করেছিলো বাঁধভাঙা জনপ্রিয়তা, বাকের ভাইয়ের চরিত্রকে আসাদুজ্জামান নূর এতো চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, সেই অতুলনীয় অভিনয়ের সুবাদে ঘরে ঘরে তখন বাকের ভাইয়ের জয়গান। পাড়ার মাস্তান, কিন্তু ভালো মানুষ বাকের ভাইয়ের বিবেক রয়েছে, সে বিবেক টাকার কাছে বিকিয়ে যায়নি, কপালদোষে মাস্তান হলেও ঠিক কাজটি করতে বাকের ভাই পিছ পা হন না। বাস্তব জীবনে সেরকম মাস্তান দুর্লভ হলেও কল্পনা করতে বাঁধা নেই, তাই বাকের ভাইয়ের ফাঁসীর আদেশ হলে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল বের হয়, ভয়ে হুমায়ুন আহমেদ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যান ক'দিনের জন্য।

নব্বইয়ের দশক শেষ হয়ে আসে, হুমায়ুনের লেখাও ম্লান হয়ে যায়, বাকের ভাইয়ের কথাও জনমানুষের মন থেকে মুছে যায়।

নব্বইয়ের দশকের শেষভাগের এক রোদেলা বিকেলে আমার মাথায় হঠাৎ ভুত চেপে বসে, একটা বেমক্কা আকারের বড়সড় হেডফোন কিনতেই হবে। বুয়েটে সদ্য প্রথম বর্ষে পড়ি, তখন সেটার হিড়িক চলছে, কানঢাকা জাহাজের হেডফোন কানে লাগালে বাইরের সব শব্দ চাপা পড়ে যায়।

পলাশীর মোড় থেকে রিকশা চেপে বন্ধু প্রদীপ্তের সাথে যাই বায়তুল মোকাররম স্টেডিয়াম মার্কেটে তখনো বসুন্দরা সিটির ঝকমকে বাজার খুলতে বহুদিন বাকি। ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতির বাজার বলতে ওটাই। বাজারে অবশ্য ঠকে যাওয়ার বিশাল সম্ভাবনা, বেকুব ক্রেতাদের মাথায় কাঁঠাল ভাঙতে বিক্রেতারা সদা তৎপর। খেয়াল করে জিনিষ না কিনলে দুই তিনগুণ দাম দিতে হবে নির্ঘাত। চোখ কান খোলা রেখে আমরা তাই হাতড়ে বেড়াচ্ছি হেডফোনের সম্ভার। সস্তা চীনা নকল হেডফোনের ভীড়ে খাঁটি জাহাজী মাল পাওয়া দুস্কর, দোকানদার নকল মাল গছাতে সদা সচেষ্ট, তাকে ঝাড়ির উপরে রেখে বিজ্ঞ চেহারা করে দুই বন্ধু সর্দারী করছি। হেডফোন দুই একটা পছন্দ হয়ে যায়, কিন্তু না পরে কিনলে ঠকে যাবো, সেই জন্য পরখ করতে থাকি।

এমন সময়ে ঘটল অভাবনীয় ঘটনা, পছন্দ হওয়া হেডফোনটা মাথায় পরে দেখতে যাওয়া মাত্র ডান পাশটা খুলে এলো অনায়াসে। বেকুব বনে গেলাম, কারণ জিনিষটা আগে থেকেই আলগা ছিলো, টেরই পাইনি।

দোকানী তো ঈদের চাঁদ পেয়ে গেল মুহূর্তেই, সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে রীতিমত ঘিরে ধরলো আমাদের। "মাল ড্যামেজ কইরা ফালাইসেন", "ক্ষতিপূরণ দেন", এহেন হুমকির বন্যা বয়ে গেলো। হেডফোনের দিকে ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম, সুকৌশলে সুপার গ্লু দিয়ে জোড়া লাগানো ছিলো, সেই সুপার গ্লু দিয়ে এটা ঠিক করার প্রস্তাব শুনে দোকানী রীতিমত ডিপজলের মতো অট্টহাসি হাসলো।

বাধ্য হয়ে বললাম, ঠিক আছে, কিনেই নেই, দাম কতো? এতক্ষণ যেসব হেডফোনের দাম চাইছিলো ২০০-৩০০ টাকা, ঝোপ বুঝে কোপ মারার সুযোগে দোকানী এখন চেয়ে বসলো ৮০০ টাকা!! আমার বন্ধুটিও সুবোধ বালক, অবস্থা দেখে ঘাবড়ে মুখ চুন, পকেটে আমাদের কারোরই ৪০০ টাকার বেশি নেই,বহুদিন ধরে পেপারে পড়ে আসা হেডলাইনগুলো ভেসে এলো, দোকানে আটকে রেখে গণপিটুনি দেয়াতে এই মার্কেট আর ঢাকা কলেজের সামনের মার্কেটগুলোর দুর্নাম দীর্ঘদিনের। দোকানীর মতিগতি দেখেও তাই মনে হলো, চ্যালাদের হাত নিশপিশ করছে যেনো আমাদের দুজনকে বাগে পেয়ে।

বুকে একটু সাহস এনে প্রতিবাদ জানালাম, ভাঙা জিনিষ কেনো এই দামে কিনবো ... কিন্তু দোকানী নাছোড়বান্দা, জরিমানা করে ছাড়বেই। আমাদের প্রতিবাদ দেখে দোকানী তার চ্যালাকে আদেশ দিলো, "অই, নুরা ভাইরে ডাক তো"!!

নূরা ভাই কে, জানিনা, কিন্তু বুঝতে বাকি রইলোনা, স্টেডিয়াম মার্কেটের বাঁধা মাস্তান "ভাই" তিনি, বেয়াড়া ক্রেতাদের শায়েস্তা করে "বানাইয়া দেয়া"র কাজটা তিনিই করে থাকেন। বুয়েটে আর আস্ত অবস্থায় ফেরত যাওয়া হবে কি না, চিন্তায় পড়ে গেলাম, দোয়া দরুদের স্টক হাতড়াতে থাকি।

আধা মিনিটেই নুরা ভাই হাজির। টিপিকাল মাস্তান চেহারা, সিনেমার পাতা থেকে উঠে আসা, গলায় সোনালী চেইন, টি শার্ট জিন্স, আর খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গাঁজা খোর লাল চোখে রাগরাগ ভঙ্গীতে আমরা দুই গোবেচারার দিকে তাকালেন, তার পর দোকানীর দিকে চেয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন, "কি হইসে"?

দোকানী বিজয়ের হাসি হেসে বললো, আমরা দুইজনে মিলে হেডফোন ভেঙে ফেলেছি, কাজেই নুরা ভাই যাতে একটু সাইজ করে দেন। আর প্রমাণ হিসাবে ভাঙা হেডফোন তুলে ধরলো নুরা ভাইয়ের কাছে।

আমাদের অবস্থা তখন কেরোসিন, আজ বোধহয় নুরা ভাইয়ের হাতে "বানানো" হতে হবে... এহেনো চরম মুহূর্তে নুরা ভাই হেডফোনটা হাতে তুলে নিলেন, একবার সুপারগ্লু দিয়ে আগে লাগানো-এখন ভাঙা টুকরাটা দেখলেন, তার পর দোকানী আর আমাদের দিকে চাইলেন।

তার পর?

অবাক করে দিয়ে আমাদের দিকে চেয়ে বললেন,"ভাই, আপনারা এখান থেকে চলে যান তো এখনই"!!

আমাদের হতভম্ব চেহারা তো আর দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু দোকানী ততোধিক হতভম্ব নুরা ভাইয়ের কথা শুনে, মিন মিন করে বলতে যাচ্ছিলো হেডফোনের কাহিনী, কিন্তু নুরা ভাইয়ের প্রকান্ড চিৎকারে চুপ মেরে গেলো, ভাঙা হেডফোন নিয়ে গোবেচারা দুজনকে হেনস্তা করার জন্য নুরা ভাই কষে কয়েকটা গালি দিলেন দোকানীকে। তার পর আবারো আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, "ভাই আপনারা চলে যান"!!

মত পাল্টানোর আগেই আমরা আর অপেক্ষা করিনি, এক দৌড়ে পগাড় পার। হেডফোন আর সেদিন কেনা হয়নি, হেডফোন কেনার শখও চলে যায় চিরতরে।

কিন্তু কী দেখে নুরা ভাই মাস্তানীর রোল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, আজো জানা হয়নি। আর মাস্তানদের মধ্যে যে দুই একজন বাকের ভাই থাকে, অন্ধকারের মধ্যে থেকেও ন্যায়নীতি, বিবেক চলে যায় না সবার -- সেই বিশ্বাস পাকা হয়েছিলো সেদিন।

হয়তো মানুষ কখনোই ১০০% খারাপ হয় না। মিলগ্রাম যাই বলুন না কেনো , হয়তো মানুষ সব অবস্থাতেই কিছুটা মনুষ্যত্ব বজায় রাখে।

পৃথিবীটা তাই আজো টিকে আছে ...

(রচনাকাল অক্টোবর ২০০৮)