Monday, April 20, 2009
আমি কী হনু রে সিনড্রোম ও তার গপ্পো
উইকিপিডিয়াকে মোটামুটি একটা আন্তর্জাতিক চিড়িয়াখানা বলা যেতে পারে, নানা কিসিমের মানুষজন নানা মতলবে আনাগোনা করে এইখানে। আমার মতো বেকুব কয়জনায় মনের সুখে জ্ঞান যোগ করে, কিন্তু বিপুল পরিমান মানুষ ঐখানে আসে অন্য ধান্ধায়। রাজনৈতিক বা ধর্মীয় গলাবাজি, কিংবা জাতীয়তাবাদের ছড়াছড়ি তো আছেই, তার সাথে গোদের উপরে বিষফোঁড়ার মতো আছে, "আমি কী হনু রে" সিনড্রোমে (আকীহরে) আক্রান্ত ব্যক্তিরা।
"আকীহরে" সিনড্রোমের মোদ্দা কথা হলো, নিজেই নিজেকে বিখ্যাত মনে করা, তার পর বিদ্যাসাগরের সেই অমৃত বাণীকে আক্ষরিক ভাবে নেয়া ("আপনা ঢাক আপনি বাজাইও। অপরকে দিলে ফাটাইয়া ফেলিতে পারে")। এহেন আকীহরে রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা উইকিতে হাজির হয়, তার পর প্রথম সুযোগেই নিজের একটা জীবনী লিখে ফেলে।
জীবনী নিবন্ধের ক্ষেত্রে উইকির বেশকিছু মাপকাঠি আছে। যেমন, লেখকদের ক্ষেত্রে নামকরা গণমাধ্যমে লেখকের লেখা নিয়ে একাধিক আলোচনা থাকলে, কিংবা লেখক পুরষ্কার পেয়ে বসলে, তারপর তাকে গুরুত্বপূর্ণ ধরা যায়। রাজনৈতিক পাতি নেতারা গুরুত্বপূর্ণ না, কিন্তু কোনো সংসদ বা অন্য পদে নির্বাচিত হলে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। এসবের মধ্যেও অনেক ফাঁক বা গ্রে এরিয়া আছে। তবে মোটামুটি ভাবে সাধারণ হিতাহিত কাণ্ডজ্ঞান থেকেই বোঝা যায়, কে আসলেই খ্যাতনামা, আর কে অখ্যাত।
সমস্যাটা দাঁড়ায় যখন আকীহরে ব্যক্তিরা হাজির হয়। শুরুতেই এরা নিজের নামে একটা এন্ট্রি খুলে বসবে। "দ্রুত বিচার আইন" এর মতো উইকিতেও "দ্রুত অপসারণ" প্রক্রিয়া আছে, তার মাধ্যমে ট্যাগ করে দেয়া যায় হাবিজাবি এন্ট্রিগুলো (যেমন "আক্কাস একজন বাংলাদেশী ছাত্র। তার বাড়ি অমুক স্থানে। ফুন লম্বর ০১৭-১২৩৪৫৬৭৮।" এরকম)। কিন্তু আকীহরে ব্যক্তিটি একটু চালাকচতুর হলেই ধরে ফেলবে, দ্রুত বিচারের খড়গ থেকে বাঁচতে হলে দুই একটা আসল/নকল "সূত্র" দিয়ে ফেলতে হবে। সেটা দিয়ে ফেললে আমলাতান্ত্রিকতায় আর ওটা দ্রুত অপসারণ করা যাবে না, যেতে হবে অপসারণ প্রস্তাবনা, অথবা অপসারণের ভোটে। ঐ অপসারণ ভোটের সময়ে একজন প্রস্তাব রাখে, আক্কাসের জীবনীটি অমুক নীতিমালার অধীনে অপসারণ করা হোক, আর বাকিরা আলোচনা করে একমত, অথবা "মানিনা" এই মতে। অবশ্য যেকোনো মতের সপক্ষে বলতে হয়, কোন যুক্তিতে -- যুক্তি-ফুক্তি ছাড়াই "আক্কাসরে ভালা পাই তাই মানি না" এই রকম কথা বললে ঐটা আমলে আনা হবে না। ৫ থেকে ৭ দিন এই ভোটের পালা চলে তার পর একজন প্রশাসক সিদ্ধান্ত নেয়, হ্যাঁ নাকি না জয়যুক্ত হয়েছে, তার পর নিবন্ধ রাখা হয় বা মোছা হয়।
বাংলাদেশের লোকদের জীবনী নিবন্ধগুলোর উপরে নজর রাখি, আগে উইকি কি এইটা মানুষে না বুঝলেও ইদানিং "সচেতনতা" বেড়ে গেছে, তাই এখন সপ্তায় না হলেও মাসে একটা দুইটা আকীহরে জীবনী যোগ হয়। বাংলাদেশী উইকিপিডিয়ানদের সংখ্যা বেশ কম, সেই সুযোগে আকীহরেরা নানা ভুজুং ভাজুং দেয়ার চেষ্টা করে, হাবিজাবি জিনিষকে "রেফারেন্স" বলে দাবী করে বসে।
উদাহরণ দেয়া যাক, লন্ডনপ্রবাসী জনৈক ব্যক্তি (নাম বলবোনা) পেশায় সম্ভবত ব্যবসায়ী, আর শখ হলো মহাকাশ সম্পর্কে পড়া, নিজের পয়সায় একটা "উপন্যাস" ছাপিয়েছেন। এই ব্যক্তির হঠাৎ আকীহরে রোগ পেয়ে বসলো, ব্যস, শুরু করে দিলেন নিজের নামে জীবনী। তাও আবার ছদ্মনামের একাধিক উইকি ইউজার অ্যাকাউন্ট থেকে (নাম আলাদা কিন্তু কাম দেখলেই বুঝি একই লোকের কাজ)। এই লোকের কাজ হলো বিভিন্ন থিওরি বের করা, তার পর দাবী করা সেই নাকি প্রথম ব্যক্তি যে ঐরকম থিওরি বের করেছে। বলাবাহুল্য, তার এইসব তত্ত্ব ছাপা হয়না কোনো গবেষণা জার্নাল কিংবা কনফারেন্সে, তার প্রকাশের ভেন্যু হলো বিভিন্ন নিউজগ্রুপ বা নিজের সাইট।
বাংলাদেশের মিডিয়ার একটা সমস্যা আছে, বিজ্ঞান বিষয়ক অনেক কিছুকেই যাচাই বাছাই না করেই এরকম প্রতারকদের কথা ফাটিয়ে লিখে (বাঙালির কৃতীত্ব এরকম ধাঁচে, "নয়ন সুপারকম্পিউটার", "কচির শূণ্য থেকে বিদ্যুৎ দ্রষ্টব্য)। তো, জনাব আকীহরে "জ্যোতির্বিদ" এরকম কিছু রিপোর্ট লিখিয়ে নিয়ে তার পর "বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিকাল অ্যাসোসিয়েশন"কেও পটিয়ে ফেললেন, তার পর কায়দা করে সেই সমিতির "অনারারি মেম্বার" হিসাবে "মর্যাদা" অর্জন করলেন। ব্যস, আকীহরে হিসাবে নিজের জীবনীতে ঐটাও ফাটিয়ে যোগ করে দিলেন, হাজার হলেও বিদেশী কারো পক্ষে নাসা আর বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিকাল অ্যাসোসিয়েশনের পার্থক্য করা কঠিন, তাই নাসার ফেলো আর বাস এর অনারারি ফেলোর পার্থক্য ধরতে না পেরে অপসারণের ভোটে জেতা যাবে সহজে, এই ধান্ধায়। সেবার অনেক কষ্টে সৃষ্টে এই আকীহরে "জ্যোতির্বিদ" এর ধাপ্পাবাজি প্রমাণ করতে পারা গেছিলো।
--
গত সপ্তাহে আরেক আকীহরে এলো, তার অবশ্য পথ অন্য, সে হলো আকীহরে গায়ক। বাংলাদেশের সঙ্গীত ধারা সম্পর্কে আগে হালনাগাদ ছিলাম, ইদানিং দূরে থাকলেও এতো দূরে নাই যে বিশ্বকোষীয় কাউকে চিনবো না। "জ্যা" আদ্যাক্ষরের এই গায়কের এন্ট্রি দেখে তাই ঘাবড়ে গেলাম, এমনই কি বয়স হলো যে এমন "বিখ্যাত" গায়ককে চিনি না!! এই আকীহরে আবার একগাদা পত্রিকার রেফারেন্স দিয়ে এসেছে তার ছদ্মনামের উইকি একাউন্ট থেকে।
খোঁড়াখুড়ি শুরু করলাম, তার পর বেরুলো অন্য ঘটনা, ডেইলি স* নামের পত্রিকার একাধিক শাখা, উদীয়মান পাতা, আর জীবনধারা পাতায় ঐ আকীহরে গায়কের নামের উল্লেখ আছে বটে, কিন্তু দুই আলাদা কলাম লেখকের লেখাতেই বিশাল এক প্যারাগ্রাফ হুবুহু মিলে যায়। পরে আরেক বাংলাদেশী উইকিপিডিয়ান নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী জানালো, ঐ পত্রিকার এসব পাতায় সাধারণত স্কুল কলেজের ছাত্ররা লিখে থাকে, তাই সম্ভবত আকীহরের বন্ধু বান্ধব টাইপের কেউ চোথা অনুসারে লিখেছে। আকীহরে আবার নিজের "মাইস্পেইস" পাতাকেও "রেফারেন্স" টেনেছিলো, পরে বেরুলো ঐ বিশাল প্রশংসামূলক কথামালা আসলে তার নিজের মাইস্পেইসের আত্মজীবনী থেকে নেয়া।
বলাই বাহুল্য, আকীহরে গায়কটির আত্মজীবনীও মানদন্ডে পাত্তা পায়নি, পটল তুলেছে ক'দিন আগে।
---
আকীহরেদের আপাতত ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে, কিন্তু এদের দৌরাত্ম ক্রমশ বেড়ে চলেছে। একসময় নিজের ওয়েবপেইজেই এদের আনাগোনা সীমিত ছিলো, কিন্তু এখন ফেইসবুকে ফ্যান ক্লাব নিজেরটা নিজেই খুলে বসা* থেকে শুরু করে উইকিতেও হানা দেয়া শুরু হয়েছে। আর তার উপরে বাংলাদেশের বাংলা পত্রিকাগুলো জব্বারীয় পুরানো কাগু-বাংলা নিয়ে বসে থাকাতে সার্চ করা সেখানে অসম্ভব, কাজেই কে আসলে বিখ্যাত, আর কে আকীহরে, তা বোঝা কষ্টকর। উইকির এটা একটা দূর্বলতা, তবে উল্লেখযোগ্যতার নীতিমালার কড়া প্রয়োগ, আর সবকিছুর রেফারেন্স প্রদান বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে আকীহরেদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা ওখানে করা হয়।
অবশ্য অনেক সময়ে আকীহরেরা নানা ফ্যাসাদেও পড়ে যায়, যেমন আকীহরে জীবনী অপসারণের প্রস্তাবনাতে অনেক সময়েই ঐ ব্যক্তিটি কীরকম নগন্য তা নিয়ে বিশাল আলাপ হয়, এবং মোছার সপক্ষের লোকেরা নানা প্রমাণ হাজির করে। গুগলের কল্যাণে এক সময়ে অনেক আকীহরের নাম দিয়ে সার্চ করলে এই সব মর্মান্তিক আলোচনাই চলে আসতো, বাস্তব জীবনে মাথা কাটা যাবার মতো সব কথা আকীহরেকে খোঁজা ব্যক্তিদের চোখে এসে যেতো। বিপুল সংখ্যক আকীহরের "মানহানী" হচ্ছে বলে উইকিকে মামলার ভয় দেখানোতে এখন আর ঐ আলোচনার পাতা গুলা গুগলকে দেখতে দেয়া হয় না।
হাজার হলেও, আকীহরে সিনড্রোম বলে কথা ... সমালোচনা সহ্য করা, কিংবা নিজেদের আসল রূপের প্রকাশ সওয়াটা তাদের পক্ষে অনেক অনেক কঠিন ...
Tuesday, April 14, 2009
স্মৃতিচারণে হ্যাল, ইলিয়াক আর মোজাইক - তারুণ্যের দিনবদল
১
National Center for Supercomputing Applications (NCSA) বা মার্কিন জাতীয় সুপারকম্পিউটার কেন্দ্রের নামটা শুনেছিলাম অনেকদিন আগেই। না শোনার অবশ্য কারণ নেই, ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের হেল্প মেনুটি খুললেই অল্প কিছুদিন আগে পর্যন্তও দেখা যেতো, তারা ওখানে ব্যবহার করেছে NCSA এর প্রযুক্তি।
ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় অ্যাট আরবানা-শ্যাম্পেইনের সাথে সুপারকম্পিউটিং এর যোগাযোগ অনেকদিনের। সেই ১৯৫২ সাল থেকে, অর্থাৎ কম্পিউটারের প্রাথমিক যুগ থেকেই এখানে সুপারকম্পিউটার বানানোর কাজ চলছে, ILLIAC -1 থেকে শুরু করে ILLIAC-4 পর্যন্ত সবগুলো কম্পিউটার একসময় এখানেই তৈরী হয়েছিলো। যারা 2001 - A Space Odyssey দেখেছেন, তারা হয়তো মনে করতে পারবেন, HAL নামের সেই খুনে কম্পিউটারটির কথা, ওর জন্ম হয়েছিলো কিন্তু এই আরবানা নামের শহরেই। (মানে, উপন্যাস ও সিনেমাতে এর জন্মস্থান দেখানো হয়েছিলো এখানে)।
২
(ছবির কম্পিউটার HAL 9000, যার জন্ম আরবানাতে)
HAL এর কথা পড়েছিলাম 2001 উপন্যাসটিতে, সে ৯০র দশকের প্রথম দিকের কথা ... তখন কি আর জানতাম, এক যুগ পরে এই ভুট্টাক্ষেতের পাঠশালাতে পড়বো এক সময়? তাই ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর প্রথম দিনেই হানা দেই কম্পিউটার বিজ্ঞান ভবনটিতে, আর কী আশ্চর্য!! সেখানকার একতলাতে HAL নামের কম্পিউটারটির উপরে বিশাল কাঁচের ডিসপ্লে!! আসলে গল্পে দেখানো হয়েছিলো (১৯৬৮ এর দিকে লেখা) যে আরবানাতে কম্পিউটার প্ল্যান্টে ১৯৯৭ সালে HAL তৈরী হয়েছিলো, তাই ১৯৯৭ সালে এখানকার কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে ঘটা করে HAL এর জন্মদিন পালন করা হয়, সাইন্স ফিকশন ভক্তরা দল বেধে সারা আমেরিকা থেকে এখানে আসে।
তো, এতো বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়কে কেনো আর্থার সি ক্লার্ক বেছে নিয়েছিলেন কম্পিউটারটির জন্মস্থান হিসাবে? তার কারণ জানতে চেয়েছিলাম এখানকার এক অধ্যাপকের কাছে, ঘটনাচক্রে তিনি আবার উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটিং নিয়ে কাজ করে থাকেন। তাঁর কাছ থেকে জানা গেলো, স্ট্যানলি কুব্রিক আর আর্থার সি ক্লার্ক সিনেমাটা বানাবার সময়ে কারিগরী উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দেন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজনকে, তার সুবাদেই HAL এর জন্মস্থান আরবানা। আসলে ষাটের দশকের শেষভাগ থেকেই কম্পিউটারের ক্ষেত্রে এখানকার সুনাম ছড়িয়েছিলো।
৩
(ILLIAC 3, বর্তমানে আস্তাকুড়ে বা গ্যারেজে পড়ে থাকা তার যন্ত্রাংশ)
ILLIAC নামের প্রথম ৩টি প্রজন্মের কম্পিউটার অতো খ্যাতি বা কুখ্যাতি পায়নি, যেটা পেয়েছিলো ILLIAC-4। এই কম্পিউটারটি সত্তরের দশকের শুরুর দকে তৈরীর পরিকল্পনা নেয়া হয়, তখনকার দিনের নতুন সব প্রযুক্তি ব্যবহার করার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু কুখ্যাতির কারণ অন্য -- এই সুপারকম্পিউটারটির অর্থায়ন আসে মার্কিন সেনাবাহিনী থেকে, আর সময়টা ভিয়েতনাম যুদ্ধের কাল, পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পাস থেকে ক্যাম্পাসে উদ্দাম তারুণ্য যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে তখন সোচ্চার। তাই এখানকার ক্যাম্পাসেও লাগে যুদ্ধবিরোধী হাওয়া, সেনাবাহিনীর পয়সায় কম্পিউটার বানিয়ে তাতে মানুষ মারার অস্ত্রের নকশা করা হবে, এরকম কোনো কিছুর বিরোধিতা করে ছাত্ররা। বিশাল সেই ছাত্র আন্দোলনের মুখে কম্পিউটারটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়, পরে ক্যাম্পাস থেকে বহু দূরে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যপ্রান্ত নাসার গবেষণাগারে তৈরী হয় এটি।
ইলিয়াকের ঘটনা ইতিহাস হয়ে যায়, মার্কি যুক্তরাষ্ট্র হেরে ভুত হয়ে ভিয়েতনাম ছেড়ে আসে, তারও ১০ বছর পর NCSA স্থাপিত হয় ১৯৮৬ সালে, মার্কিন সরকার পুরো দেশজুড়ে কয়েকটি জায়গায় সুপারকম্পিউটারের গবেষণাগার বানায়, যাতে করে পুরো দেশের বিজ্ঞানীরা এগুলো ব্যবহার করতে পারে। NCSA তে গত এই ২৩ বছর জুড়ে অনেকগুলো প্রচন্ড ক্ষমতাধর সুপারকম্পিউটার স্থাপিত ও তৈরী হয়েছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শাখার গবেষকেরা নিজেদের সুপারকম্পিউটার না থাকলেও দূরনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এগুলো ব্যবহার করতে পেরেছেন।
--
৪
আমি যখন পা রাখি ভুট্টা ক্ষেতে, তখন সবাইকে প্রশ্ন করি, NCSA ভবনটি কোথায়। কোথায় গেলে দেখতে পাবো এই বিখ্যাত গবেষণাগারটিকে। জবাবে ৫টি ঠিকানা পেলাম, জানলাম পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে ছড়িয়ে আছে এটি। এর মধ্যে একটি ভবন নাকি বানানো হয়েছিলো পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঠেকানোর মতো শক্ত করে, যাতে তার ভেতরে থাকা সুপারকম্পিউটারটি রক্ষা পায়। এখন অবশ্য সুপারকম্পিউটার বলতে অতিকায় কোনো একটি মাত্র যন্ত্র বানানো হয়না, বরং র্যাকে রাখা হাজার কয়েক সাধারণ কম্পিউটারকে যুক্ত করে ক্লাস্টারভিত্তিক সুপারকম্পিউটার বানাবার চল এসেছে বহুদিন। তাই সুপারকম্পিউটারের কেন্দ্র হিসেবে NCSA এর খ্যাতিতে ভাগ বসিয়েছে অনেকেই। তার পরেও মাঝে মাঝেই প্রথম ১০ তালিকাতে এদের সুপারকম্পিউটার এসে যায়।
২০০৪ এর শুরুতে NCSA-তে কাজ করার সুযোগ পাই, অবশ্য কোনো সুপারকম্পিউটারবিদের সাথে না, বরং একজন কম্পিউটেশনাল অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্টের সাথে। খটোমটো যে পদবীটি এই বিজ্ঞানীর ছিলো, তার সার কথা হলো, ইনি কম্পিউটার বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, আর জ্যোতির্বিজ্ঞানের সংমিশ্রণে কাজ করেন। কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে আসা তারার মিটিমিটি আলোকে কিংবা বেতার তরঙ্গকে ধরতে নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে বসেছে কয়েকশো রেডিও দূরবীন, সেখানকার সংকেতগুলোর বিপুল পরিমাণ উপাত্ত থেকে এই বিজ্ঞানী ছবি তৈরী করেন, ২০০০ সালের দিকে এক তারার মৃত্যুদৃশ্যের ছবি প্রকাশ করে পুরো বিশ্বজুড়ে খবর হয়েছিলেন।
একদিন অবশ্য সুপারকম্পিউটারের পেটের ভেতরে যাবার সুযোগ ঘটে। বেশ কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনো, ভবনে ঢোকার আগে বাইরে ক্যামেরা দিয়ে দেখে যাচাই করা হলো, সাথে পাহারাদার দেয়া হলো আমাদের। পেটের ভেতরে বললাম, কারণ পুরো বিশাল একটি কক্ষজুড়ে লাইব্রেরীর তাকের মতো অনেকগুলো শেলফ, আর তাতে বসানো আছে কয়েকহাজার নোড। প্রচন্ড তাপ সৃষ্টি হয়, তাই পুরো ঘরটির মেঝের নিচে বসানো আছে শীতাতপ যন্ত্র। এটি ছিলো তখন বিশ্বের ৪র্থ দ্রুততম সুপারকম্পিউটার।
(Abe নামের সুপারকম্পিউটারের কিয়দংশ) |
---
৫
NCSA এর নাম আমি যে কারণে শোনার কথা শুরুতে বলেছিলাম, তার সাথেও মুখোমুখি হতে হয়, অবশ্য অন্যভাবে। নতুন তৈরী হওয়া NCSA ভবনের সামনে স্থাপিত হয় একটি ফলক, আগ্রহভরে দেখতে গিয়ে দেখি, প্রথম বহুল প্রচলিত ওয়েব ব্রাউজার মোজাইকের স্মারক ফলক ওটি (পুরো ক্যাম্পাসে স্থাপিত অন্য দুটি ফলকের একটি ২বার নোবেল বিজয়ী জন বার্ডিন, আর সিনেমাতে শব্দ যোগ করা বিজ্ঞানীটির স্মরণে)। ঘটনা হলো, এই NCSA তে কর্মরত অবস্থাতেই ১৯৯৩ সালে মার্ক অ্যান্ড্রিসেন আর এরিক বিনা নামের দুজন প্রোগ্রামার মাত্র একটি সপ্তাহান্তে বসে এই ব্রাউজারটি তৈরী করেন, দুজনে পরে শুরু করেন নেটস্কেপ নামের কোম্পানিটি, নব্বইয়ের দশকের যা পরাক্রমশালী মাইক্রোসফটেরও ত্রাস হয়ে যায়, নেটস্কেপ নামের ব্রাউজারটি দিয়ে।
৬
মোজাইকের প্রযুক্তিটি অবশ্য মাইক্রোসফট নিজেও লাইসেন্স করে ব্যবহার করে, আর সে জন্যেই গত সংস্করণ অবধি ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের কৃতজ্ঞতা স্বীকার পাতায় NCSA এর কথা বলা থাকতো। আমি মুখোমুখি হই অন্যজিনিষের, আমার প্রফেসর তাঁর পরিবারের সাথে যেদিন পরিচয় করিয়ে দিলেন, সেদিনই দেখা মিলে এরিক বিনার সাথে, যিনি আমার অ্যাডভাইজরের স্বামী। পিকনিকে এরিকের সাথে খোশগল্পের ফাঁকে ফাঁকে জানতে পারি মজার কাহিনী, মোজাইক বানানোর কাজটা ওরা করেছিলো NCSA তে কর্মরত অবস্থাতে, তাই নেটস্কেপ কোম্পানী খোলার সময়ে লাইসেন্স করার দরকার হয়। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো মাথামোটা কর্মকর্তাকে প্রস্তাব দেয়া হয়, নেটস্কেপ কোম্পানি বা অন্য যারাই ব্রাউজার প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করবে, তারা তাদের লভ্যাংশের একটা বড় অংশ বিশ্ববিদ্যালয়কে দেবে। মাথামোটা কর্মকর্তা এরকম "অলাভজনক" প্রস্তাবে রাজি হয়নি, বরং বলে, এসবের বদলে কয়েক লাখ ডলার দিলেই অনেক ভালো, তাই সানন্দে মেনে নেয় নেটস্কেপ ও অন্যান্যরা, পরে যখন নেটস্কেপ সহ অন্যান্য ব্রাউজার কোম্পানির লালে লাল রমরমা অবস্থা হয় আর মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দাম হয়ে যায়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথায় হাত। বেকুব একেই বলে আর কি।
----
নিজের গবেষণার ফাঁকে ফাঁকে NCSA কাজ করেছি প্রায়ই, বিজ্ঞানীটির সাথে ছাড়াও এখানকার সিকিউরিটি গ্রুপের সাথে কাজ করেছি। চমৎকার এই গবেষণাগারটিতে দেখার মতো অনেক কিছুই আছে, তার মধ্যে একটি হলো The Cave, তথা একটি ভার্চুয়াল রিয়ালিটি কক্ষ,যাতে ঢুকে নক্ষত্রমালার মাঝে ঘুরে বেড়ানো যায়, অথবা মানবদেহের মধ্যে ভ্রমণ করা চলে ভার্চুয়ালি। পুরো প্রতিষ্ঠানে নানান দেশের কয়েকশ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী কাজ করেন, বাংলাদেশী একজন প্রকৌশলী কাজ করতেন-- এখন অবশ্য উনি নেই, আর রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্টদের মধ্যে আমি ও আর দুই একজন কাজ করেছেন।
পাদটীকা
সর্বসাম্প্রতিক খবর হলো, এখানে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী সুপারকম্পিউটার ব্লু ওয়াটার্স বানাবার কাজ শুরু হয়েছে। এটাও মার্কিন সরকারের অর্থায়নে ও আইবিএমের সহযোগিতায়। হয়তোবা মানবকল্যাণ, ক্যান্সার গবেষণা, এসব কাজে ব্যবহার হবে এটি, অথবা মারণাস্ত্রের নকশা প্রণয়নে, কিন্তু ষাটের দশকের বিশ্ব আর নেই, তাই নেই এই সুপারকম্পিউটারটির বিরোধিতা।
পৃথিবীটা বদলে গেছে, পালটে গেছে তারুণ্যও ...
Tuesday, February 17, 2009
যন্ত্র গণকের যন্তর মন্তর - ২
করিম সাহেবের জাম্বুরা কেনা | |
করিম সাহেব বাজারে গিয়েছেন জাম্বুরা কিনতে। দোকানী এক গাদা জাম্বুরা সাজিয়ে বসে আছে, সবগুলো দেখতে একই আকারের লাগছে। কিন্তু জাম্বুরা কিনে কিনে চুল পাকানো করিম সাহেব ভালো করেই জানেন, জাম্বুরা যত ভারী হবে, ততো তার স্বাদ ভালো, মজা বেশি। প্রশ্ন হলো, করিম সাহেব কী করে একগাদা জাম্বুরা থেকে সবচেয়ে ভারীটি বের করবেন। |
পাঠ ২
কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এ এরকম সমস্যা প্রায়ই আসে, একটা তালিকা থেকে সবচেয়ে বেশি বা কম বা এরকম কিছু একটাকে খুঁজে বের করতে হবে। ধরা যাক, ১০০টা সংখ্যা দেয়া আছে, তার থেকে সবচেয়ে বড় সংখ্যাটা বের করতে হবে।
বিশাল সমস্যা! বেকুব কম্পিউটারকে পুরাটা একবারে দিলে লেজে-গোবরে করে ফেলবে। আসুন, প্রথমে সমস্যাটাকে ছোট করে ফেলি।
১টা যদি সংখ্যা হয়, তাহলে তো আর ঝামেলা নাই। যেটা আছে, সেটাই সবচেয়ে বড়। কাজ শেষ।
২টা যদি সংখ্যা হয়, তাহলে তাদের তুলনা করলেই পাবো কোনটা বড়। সংখ্যা দুইটা ডানহাত ও বামহাত – এই দুই জায়গায় নিয়ে বুঝতে পারি কোনটা বড়। করিম সাহেবের সমস্যায় যদি ফেরত যাই, তাহলে করিম সাহেব দুইটা জাম্বুরা দুই হাতে নিয়ে বুঝতে পারবেন সহজেই কোনটা ভারি।
এখন যদি দুই এর বেশি হয়, ধরা যাক ৩টা, তাহলে? সেটাও সহজ, প্রথমে করিম সাহেব প্রথম দুইটা জাম্বুরা দুই হাতে নিলেন, ধরা যাক ডান হাতেরটা ভারি। তখন বাম হাতেরটা ফেলে ৩য় জাম্বুরাটা বাম হাতে নিলেন, দেখতে চেষ্টা করলেন কোনটা ভারি। ডান হাতে আছে প্রথম দুইটার মধ্যের ভারিটা, আর বাম হাতে অন্যটা, এর মধ্যে যেইটা ভারি হবে, সেটাই ৩টা জাম্বুরার সবচেয়ে ভারিটা।
এই কাজটাকে একটু সাংকেতিক ভাবে এভাবে লেখা যায়, ধরাযাক সংখ্যাগুলো আছে x, y, z এই তিনটা নামে,
যদি X ও Y এর মধ্যে x বড় হয়, তাহলে x ও z এর মধ্যে যেটা বড়, সেটাই বৃহত্তম,
অন্যথায় যদি
X ও Y এর মধ্যে Y বড় হয়, তাহলে y ও z এর মধ্যে যেটা বড়, সেটাই বৃহত্তম।
এই কথাটাই যেকোনো প্রোগ্রামিং ভাষায় লেখা যায়, যেমন ধরুন C ভাষায় লেখা যায় –
if (x>y) { // যদি if (x>z) largest = x else largest = z; } else { if (y>z) largest = y; else largest = z; } |
দুর্বোধ্য লাগছে? আসলেই ... এই জিনিষটাকে আরো সংক্ষেপে খুব সহজেই লিখতে পারি এইভাবে -
if x>y largest = x else largest =y; if z>largest then largest = z; |
মানে তিনটা সংখ্যার প্রথম দুইটার মধ্যে বড় যেটা, সেটার সাথে পরেরটার তুলনা করে যেটাকে বড় পাবো, সেটাই সবচেয়ে বড়।
আচ্ছা, ৩টা সংখ্যার মধ্যে না হয় এই দুই লাইনে বের করা গেলো বড় সংখ্যাটি। কিন্তু যদি ৩টার যায়গায় ৩০০ বা ১কোটি সংখ্যা থাকে? করিম সাহেবের কথাই ধরা যাক, ঝুড়িতে যদি ৫০টি জাম্বুরা থাকে, তাহলে কী করবেন তিনি?
মূলনীতিটা কিন্তু একই থাকছে, কাজেই এভাবে আগানো যেতে পারে,
শুরুতে কোনটা ভারী, তা করিম সাহেব জানেননা, তাই তিনি আন্দাজে একটা বেছে নিয়ে ধরলেন সেইটাই সবচেয়ে ভারী। ঐ জাম্বুরাটাকে নিয়ে রাখলেন ডানহাতে। এবার ঝুড়ি থেকে একটা একটা জাম্বুরা বাম হাতে নেন, আর দেখেন ডান হাতেরটার চেয়ে এই নতুনটা ভারী কি না। যদি ভারী হয়, তাহলে কথাই নেই, ডান হাতেরটাকে অন্য কোথাও রেখে দিয়ে ডান হাতে পাচার করে দেন বা হাত থেকে নতুন ভারী জাম্বুরাটি। এভাবে একটা একটা করে ঝুড়ির সবগুলো দেখা হয়ে গেলে সব শেষে করিম সাহেবের ডান হাতে যা থাকছে, সেটাই ঝুড়ির সবচেয়ে ভারী জাম্বুরা। |
এবার বেকুব কম্পিউটারকে এরকম ব্যাপার কীভাবে সাংকেতিক উপায়ে বোঝানো যায়, তার একটা রূপরেখা দেখা যাক। ধরাযাক, ১০০টি জাম্বুরা আছে, যাদের নম্বর দেয়া হলো ০ থেকে ৯৯ পর্যন্ত (কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা আবার ০ থেকে গোণা শুরু করে)। আর জাম্বুরা গুলোর ওজন ধরা যাক আছে weight[0] থেকে weight[99] এভাবে।
আমাদের কাজ হবে বেকুব কম্পিউটারকে বোঝানো, ১০০টি জিনিষের মধ্যে সবচেয়ে ভারী কোনটা, সেটার ক্রমিক নম্বরটি আমাদের জানানোর কৌশল।
শুরুতে, ধরে নেই প্রথমটি সবচেয়ে ভারী।
heaviest = 0 ; (প্রথমটির ক্রমিক নং হলো ০ ) |
আর সবচেয়ে ভারী জাম্বুরাটির ওজন আমরা মনে রাখবো max_weight নামে, প্রথমে যেহেতু ধরেছি শুরুর জাম্বুরার ওজন বেশি, তাই সেটার ওজনকেই এখানে মনে রাখি।
max_weight = weight[0]; |
এবার এক এক করে বাকি গুলোকে পরীক্ষা করি, দেখি এই max_weight এর বেশি পাই কি না
(আমরা একটা একটা করে না লিখে বেকুব কম্পিউটার যেইটা ভালো পারে, সেই পুনরাবৃত্তি তথা লুপের মাধ্যমে করা যায়। সংখ্যা যেহেতু ১০০টি, কাজেই আমাদের অত বার মাপামাপির কাজ করলেই চলবে। এই জন্য কম্পিউটারকে নির্দেশ দেয়া যাক, ১০০ বার সে একটা করে ওজন তুলুক, তার পর দেখুক এইটা আগের চেয়ে ভারী কি না)
for (i = 1; i<100;> | এখন কোনটা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে, তা i এর মধ্যে রাখবো, আর প্রতি বার লুপের ভিতরের কাজ শেষ হলে ১ করে বাড়াবো। প্রথমটা (০তম) তো দেখেই ফেলেছি, তাই এখন দ্বিতীয়টা, মানে ক্রমিক নং ১থেকে ৯৯ পর্যন্ত বাকি ৯৯টা নিয়ে দেখলেই চলবে) |
if (weight[i]>max_weight){ | // আগের ওজনদার-তম জাম্বুরার চাইতে এই নতুনটা ভারী কি? |
heaviest = i; max_weight=weight[i] } | (তাহলে এই নতুনটাই সবচেয়ে ভারী) (ঐটার ওজনটা মনে রেখে দিলাম) |
ব্যস, এই কাজটুকু শেষ ওজন পর্যন্ত করে গেলেই সব শেষে heaviest এর মধ্যে পাবো সবচে ভারী জাম্বুরাটির ক্রমিক নম্বর, আর তার ওজন পাবো max_weight এর মধ্যে।
---
সুতরাং, আজকের পাঠে আমরা দেখতে পেলাম, ভারী হালকা বের করার কাজটা আমরা সুকৌশলে বেকুব কম্পিউটারের ঘাড়ে গছিয়ে দিতে পারি, যাতে করে আমরা নাকে তেল দিয়ে আরামে ঘুমোতে পারি, আর করিম সাহেবও জাম্বুরা কেনায় বিশাল দাওটি মারতে পারেন।
Saturday, February 14, 2009
যন্ত্র গণকের যন্তর মন্তর - ১
ভূমিকা |
আমার ছেলেবেলায় বিটিভিতে “বিন্দু থেকে সিন্ধু” নামের একটা অনুষ্ঠান দেখাতো। আশির দশকের কথা ... কম্পিউটার তখন দেশে আছে হাতে গোণা কয়েকটা মাত্র। টিভিতে সেই জাদুর বাক্স দেখে অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে রইতাম, ভাবতাম কী জাদু জানে এই যন্ত্রটা, কীভাবে করে দেয় সব কাজ। ঘটনাচক্রে আমার বিদ্যা লাভ করা হয় এই গণক প্রকৌশলেই। প্রোগ্রামিং শেখার শুরুটা আমার কাগজে কলমে, মানে কম্পিউটার কেনার আগেই প্রোগ্রামিং শেখা শুরু করি, মাস খানেক পরে সারা জীবনের বৃত্তির টাকাগুলো ভেঙে কম্পিউটার কেনা হয়। সে এক যুগ আগের কথা। এই এক যুগ ধরে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখার বই এক গাদা দেখলাম। সেই হার্বার্ট শিল্ড থেকে শুরু করে ডেইটেল অ্যান্ড ডেইটেল সহ অনেক লেখকের লেখা সি বা জাভা শেখার বই পড়েছি, পড়িয়েছি। কিন্তু সবগুলো বইয়েরই একটা সাধারন বৈশিষ্ট্য, তা হলো, বইগুলোতে “প্রোগ্রামিং” শেখানো হয়না, যা শেখানো হয় তা হলো সংশ্লিষ্ট ভাষাটির বৈশিষ্ট্য, এবং তা দিয়ে কীভাবে প্রোগ্রাম লেখা যায়। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর যে মূল ধারণা, তা সব ভাষার জন্যই প্রায় সমান। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বইগুলোতে সেরকম করে মূল ধারণাগুলোর বদলে প্রায়োগিক দিকগুলোই প্রাধান্য পায়। বুয়েটে শিক্ষকতার স্বল্প সময়ে প্রোগ্রামিং শেখাবার কোর্স আমি পাইনি, আর পেলেও লাভ হতোনা, কারণ গৎবাঁধা সিলেবাস আমূল পালটে ফেলাটা রীতিমত “অপরাধ” সেখানে। তাই অনেক দিন থেকেই আমার ইচ্ছা, একটা বই লিখবো, যাতে এই ব্যাপারে খুব সহজ করে কথাগুলো বলা যাবে। এই ধারাবাহিক লেখাগুলো এই সিরিজেরই অংশ। এই লেখাগুলো প্রোগ্রামিং যারা জানেন, তাদের জন্য মামুলি ব্যাপার। এটা মূলত একেবারে কম্পু-কানা নবীস শিক্ষার্থীদের জন্য। তাই ভাষাগত জটিলতা দেখতে পেলেই জানিয়ে দেবেন, আমি ভাষাগুলো আরো সহজ করার চেষ্টা করবো। মিস্তিরি মানুষ হিসাবে ভাষায় দক্ষতা আমার নগন্য, কাজেই দুর্বোধ্য ভাষার ব্যবহার দেখলে সেটাও ধরিয়ে দেবেন। |
কম্পিউটারের বুদ্ধি কতটুকু? গল্প উপন্যাসে যাই পড়ে থাকুননা কেনো শুরুতেই একটা গোপন কথা ফাঁস করে দেই -- কম্পিউটার একটা চরম নির্বোধ যন্ত্র মাত্র। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখার আগেই তাই এই বিষয়টা মেনে নিতে হবে ... টিভি ফ্রিজ বা ওয়াশিং মেশিন, অথবা বাসার ফ্যানটির মতো যেমন বিদ্যুৎ দিয়ে চলে, ঠিক তেমনি কম্পিউটারও বিদ্যুতে চলা একটি যন্ত্র।
তাহলে, কম্পিউটার এতো সব সমস্যার সমাধান কীকরে করে? এর মূলে রয়েছে অ্যালগরিদম, বা গণনা পদ্ধতি। সহজ ভাষায় বলতে গেলে কম্পিউটার সমস্যা সমাধান করতে পারে, তার একমাত্র কারণ হলো, আমরাই সমস্যাগুলোকে ছোট ছোট ভাগে ভেঙে দেই, আর কীভাবে সমাধান করতে হবে, তাও কম্পিউটারকে বাতলে দেই। এই “বাতলে দেয়া বুদ্ধি”টুকু বাদে কম্পিউটার কেবলই সিলিকন-জার্মেনিয়ামের কিছু যন্ত্রাংশের সমাহার।
কম্পিউটার তাহলে কেনো এতো সফল? তার কারণ একটাই, আমাদের বাতলে দেয়া পদ্ধতিতে ছোট ছোট কাজগুলো প্রচন্ড দ্রুতগতিতে কম্পিউটার করতে পারে। হিসাব নিকাশ করার জন্য কম্পিউটারের যে সার্কিট বা বর্তনী রয়েছে, তাতে প্রতি সেকেন্ডে লাখ লাখ থেকে কোটি কোটি ওরকম হিসাব করা যায়। তাই আমাদের বাতলে দেয়া পদ্ধতিতে ছোট ছোট সেই ধাপগুলো কম্পিউটার চোখের নিমেষে করে ফেলে।
কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর মূল কথা হলো সমস্যা সমাধানকে ছোট ছোট ধাপে ভেঙে ফেলা। একেবারে বড় সমস্যা সমাধান হয়তো কঠিন, কিন্তু সমস্যাটাকে সমাধানযোগ্য ছোট ছোট ধাপে ভাগ করে ফেলতে পারলেই কম্পিউটারের মতো নির্বোধ যন্ত্র দিয়ে সেটা সমাধান করা যাবে।
আজ আমরা একটা গাণিতিক সমস্যা দিয়ে এই ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করবো। ধরা যাক, আপনাকে বলা হলো ১ থেকে ৫ পর্যন্ত সংখ্যাগুলোর যোগফল বের করতে হবে, অর্থাৎ ১+২+৩+৪+৫=? । কাজটা খুবই সহজ, ক্লাস ২ এর বাচ্চাদের দিলে আধা মিনিটেই জবাব দিয়ে দেবে, প্রশ্ন হলো কম্পিউটারকে কীভাবে বোঝাবো সেটা। তার আগে আপনি নিজে ভেবে দেখুন, আপনাকে কাজটা করতে দিলে কীভাবে সেটা করবেন।
খুব আস্তে আস্তে ভাবুন। আপনি নিশ্চয়ই এক বারে ৫টা সংখ্যা যোগ করে বসেননি, তাই না? কাজটা যদি কাগজে কলমে দেয়া হয়, তাহলে আমরা সংখ্যাগুলোকে একটার নিচে আরেকটা লিখে ফেলি। তার পর উপর থেকে শুরু করি, একটা করে সংখ্যা নেই, এপর্যন্ত যা যোগফল ছিলো, তার সাথে সংখ্যাটা যোগ করি, তার পর একই কাজ পরের সংখ্যাটা দিয়ে করি। মুখে মুখে এভাবে চিন্তা করি, "এক আর দুইয়ে তিন, তিন আর তিনে ছয়, ছয় আর চারে দশ, দশ আর পাঁচে পনের", অর্থাৎ আমাদের চিন্তাটা ধাপে ধাপে আগাচ্ছে, প্রতি ধাপে একটা করে সংখ্যা আমরা আগের যোগফলে যোগ করে দিচ্ছি।
হাতে হাতে করার জন্য, ধরা যাক আমরা টেবিলের উপরে ১ থেকে ৫ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো রেখেছি, আর ডান হাতে সাময়িক যোগফলগুলো রাখবো। যোগ করার বুদ্ধিটা করলাম এমন, বাঁ হাত দিয়ে টেবিল থেকে একটা সংখ্যা তুলবো, আর সেটাকে ডান হাতে যা ছিলো তার সাথে যোগ করে ডান হাতেই ধরে রাখবো।
যেমন, ১ হতে ৫ পর্যন্ত যোগ করতে হলে, প্রথমে ডান হাতে কিছুই নাই, মানে ০। প্রথম সংখ্যাটি ১। সেটাকে শূন্যের সাথে যোগ করে পেলাম ১। পরের সংখ্যাটি ২, সেটাকে আমাদের এপর্যন্ত যোগফল ১ এর সাথে সেটাকে যোগ দিলে হয় যোগফল ৩। পরের সংখ্যাটা ৩, সেটাকে আমাদের এপর্যন্ত যোগফল ৩ এর সাথে যোগ করে পেলাম নতুন ফল ৬। পরের সংখ্যাটা ৪, সেটাকে আমাদের এপর্যন্ত যোগফল ৬ এর সাথে যোগ করে পেলাম নতুন ফল ১০। পরের সংখ্যাটা ৫, সেটাকে আমাদের এপর্যন্ত যোগফল ১০ এর সাথে যোগ করে পেলাম নতুন ফল ১৫। |
ব্যস, আমাদের যোগফল বের করার কাজটা শেষ, ১ থেকে ৫ এর যোগ ফল দাঁড়ালো ১৫।
উপরের হিসাবের ধাপগুলো দেখলে একটা জিনিষ হয়তো খেয়াল হবে, আমরা একই রকম কাজ (মানে বাঁ হাত দিয়ে টেবিল থেকে সংখ্যা তোলা, আর ডান হাতের সংখ্যাটার সাথে যোগ করার কাজটা) বার বার করছি, কেবল টেবিল থেকে তোলা সংখ্যাটা পালটে যাচ্ছে। আর আমরা এই পুনরাবৃত্তি করছি একটা সীমা পর্যন্ত, মানে ১ থেকে ৫ পর্যন্ত যোগ ফল বের করার ব্যাপার থাকলে টেবিল থেকে ৫ তোলার পরেই থেমে যাচ্ছি। টেবিলের উপরে আরো অনেক সংখ্যা থাকতে পারে, কিন্তু আমরা খেয়াল করে ৫ পর্যন্ত তুলেই থামছি।
এখন দেখা যাক, এই কাজটা বেকুব যন্ত্রগণককে কীভাবে বোঝানো যায় –
ডান হাতে শুরুতে কিছু নাই | #(প্রথম ধাপ)# ডানহাতে = ০ একেবারে শুরুতে বাম হাতও খালি #(দ্বিতীয় ধাপ)# বামহাত = ০ আমরা যেটা করবো, তা হলো বাম হাতে একটা একটা সংখ্যা তুলবো, শর্ত ৫ পর্যন্ত তুলার পরে থামবো। প্রতিবারে বাম হাতে আগে যা তুলেছিলাম, তার পরের সংখ্যাটি উঠাবো। #(তৃতীয় ধাপ)# বামহাত (নতুন মান) = বাম হাতের আগের মান + ১ এইবার ডানহাতে যা ছিলো, তার সাথে বাম হাতেরটা যোগ করে ডান হাতেই রাখবো | #(চতুর্থ ধাপ)# ডান হাত (নতুন মান) = ডান হাতের পুরানো মান + বাম হাতে যা তুলেছি। এখন কাজ কি শেষ হয়েছে? মানে বাম হাতে ৫ তুলে ফেলেছি কি? যদি ফেলে থাকি, তাহলে কাজ শেষ, নইলে আবার উপরের ধাপে ফিরে যেতে হবে। #(পঞ্চম ধাপ)# বাম হাতে যদি ৫ এর চেয়ে ছোট সংখ্যা থাকে, তাহলে কাজ শেষ হয়নি, সুতরাং তৃতীয় ধাপে ফেরত যাই। নইলে কাজ শেষ, পরের ধাপে যাই। #(ষষ্ঠ ধাপ)# ডান হাতে যা আছে, সেটাই যোগফল, চটপট বলে ফেলি সেটা স্যারকে। |
তাহলে ৫ পর্যন্ত যোগ করাটা বোঝা গেলো। ১০০ পর্যন্ত কীভাবে যোগ হবে? একই পদ্ধতি, তাই না? কেবল শর্তের লাইনটিতে ৫ তুলে ফেলেছি কি না তার বদলে আমরা দেখবো ১০০ তুলেছি কি না। সেই একটা সংখ্যা পালটে দিলেই উপরের পদ্ধতিতে ১০০ পর্যন্তও যোগ করা যাবে।
কম্পিউটারের সুবিধা হলো, এই বাম হাত ডান হাতের ব্যাপারটা আর শর্তগুলো একবার বুঝিয়ে দিলে কাজটা সে ৫ পর্যন্ত না, ৫ কোটি পর্যন্তও করতে দিলে অনায়াসে করতে থাকবে। বাচ্চাদের মতো বিস্কুট চকলেটের লোভ দেখিয়ে অংক করতে বসানো লাগবে না।
এই বুদ্ধিটা একটা সি ল্যাঙ্গুয়েজের প্রোগ্রাম আকারে লিখলে কেমন দাঁড়াবে দেখা যাক,
rightHand = 0 (ডান হাত শুরুতে খালি) leftHand = 0 (শুরুতে বাম হাতও খালি) do { rightHand = leftHand + rightHand (ডানহাতে আগে যা ছিলো, তার সাথে বামহাতেরটা যোগ করি, তারপর যোগফলটা ডান হাতেই জমা রাখি।) } while (leftHand <5)> |
do–while দিয়ে লেখা অংশটি একটি লুপ বা চক্রকোড। সেটি চলবে ততক্ষণ, যখন while এর পরের শর্তটি সত্য থাকবে। যতক্ষণ ঐ শর্তটি সত্য থাকবে, প্রোগ্রামটি লুপের শেষ মাথায় পৌছে আবার প্রথম অংশে লাফ দিয়ে যাবে।
বাম হাতে ১ থেকে ৫ পর্যন্ত সংখ্যা তুলে ফেলার পর শেষ বারে শর্তটি ভঙ্গ হবে, (কারণ বাম হাতে ৫), তখন এই লুপ আর চলবে না, লুপ শেষ হয়ে পরের অংশের কাজ শুরু হবে।
ব্যস, এটাই হলো কম্পিউটারে সংখ্যা যোগের একটা প্রোগ্রাম।
------
(ব্যাখ্যা ছাড়া সি কোডটি হবে নিচের মতো)
rightHand = 0; do { |
Sunday, February 1, 2009
কনশিতার দিনরাত্রি
০১
কম্পিউটার নিরাপত্তার উপরে সবচেয়ে বড় কনফারেন্সের একটি হলো এসিএম সিসিএস - প্রতিবছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির উপকণ্ঠের আলেক্সান্দ্রিয়াতে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এই কনফারেন্সের উপলক্ষেই ২০০৬ এর শরতে ওখানে আমাদের যাওয়া। কনফারেন্স শেষে একটা দিন হাতে রেখেছিলাম, আমি আর আমার স্ত্রী জারিয়া ওয়াশিংটন শহরটা ঘুরে দেখার জন্য।
পুরো শহরের সুরম্য সব অট্টালিকা আর মনুমেন্ট দেখে দেখে শরতের সেই রোদেলা বিকেলে চলে আসি মার্কিন রাষ্ট্রপতির সরকারী বাসস্থান হোয়াইট হাউজের পাশে। দুনিয়ার একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ভবনের চারপাশে অবশ্য দৃশ্যমান নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি নেই। বাংলাদেশে যেমন রাষ্ট্রপতির বাসভবনের ধারে কাছে কাক পক্ষীকেও ঘেঁষতে দেয়না পুলিশের ব্যুহ, তেমনটা দেখা যাচ্ছেনা। চারিদিকে পর্যটকদের ভিড়, হোয়াইট হাউজের একেবারে দেয়াল ঘেঁষে এমনকি দেয়ালের ফাঁক দিয়ে ক্যামেরা গলিয়ে চটাপট ছবি তুলছে সবাই।
জারিয়া আর আমি হোয়াইট হাউজের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকি, ভাবি এই নিতান্তই সাধারন চেহারার ভবনে দুনিয়া পালটে দেয়া ভালো মন্দ কতো সব ঘটনার সূচনা হয়, কতো কিছুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। হোয়াইট হাউজের বিশাল পরিধি ঘুরে আসতে আসতে এসে যাই পেছনের দিকে, পেছনেই রয়েছে এক চিলতে জমিতে করা ছোট্ট একটা পার্ক। অন্য সব ট্যুরিস্টের সাথে আমরাও ছবি তুলতে থাকি, শক্তিমান রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রাণকেন্দ্রের স্মৃতি ধরে রাখতে।
এমনি সময় আমার চোখ পড়ে পেছনের সেই পার্কটির দিকে। হোয়াইট হাউজের সীমানা প্রাচীর, তার পাশে একফালি রাস্তার ঠিক পরেই, ফুট পচিশেক দূরত্বে লাফায়েত স্কয়ার নামের পার্কের সীমানা। সেই সীমানার শুরুতেই এক বেঞ্চ আর তার পাশে রঙ্গীলা এক ছাউনি তৈরী করে বসে থাকতে দেখি প্রৌঢ়া এক রমণীকে। যুক্তরাষ্ট্রের বহু শহরে ঘোরার অভিজ্ঞতা থাকায় গৃহহীন মানুষের দেখা পেয়েছি বিস্তর, কিন্তু বিস্মিত হই খোদ হোয়াইট হাউজের পাশেই গৃহহীন ভিক্ষুকের বসতি দেখে। “দেশের সবার কাছে গল্প করা যাবে”, তা ভেবে পটাপট ছবি তুলে নেই ক্লান্ত চোখে চেয়ে থাকা এই রমণীর। তার পর ভুলে যাই তাঁর কথা ... সুরম্য ভবন আর সমাধির চাকচিক্যে হারিয়ে যায় সেই রমণীর কাতর দৃষ্টির স্মৃতি।
০২
আরবানাতে ফিরে যাই, কাজে কর্মে ব্যস্ত হয়ে মনে থাকেনা ছবিটির কথা। মাসখানেক পরে এক অলস দুপুরে ল্যাপটপের পর্দায় ছবিটা আবার ভেসে আসে, অকস্মাৎ কৌতুহল জেগে উঠে মনে। গুগলে খুঁজতে থাকি, কে এই রমণী, কীভাবে রাষ্ট্রপতি ভবনের পাশেই রয়েছে তাঁর বসতি। পরিচয়টা যখন জানতে পারি, অবাক বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে থাকি কিছুক্ষণ।
ক্লান্ত নয়নের এই প্রৌঢ়া রমণীর নাম কনসেপশন পিচ্চিওত্তো। বন্ধুদের কাছে কনশিতা বা কনি নামে পরিচিত কনসেপশনের জন্ম স্পেনে, ১৯৪৫ সালে। পরাক্রমশালী মার্কিন রাষ্ট্রপতির যেখানে বাস, সেই হোয়াইট হাউজের পেছনের লাফায়েত স্কয়ার পার্কে বসে কনশিতা নীরব প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন, পথকে নিজের ঘর বানিয়ে দিনরাত ২৪ ঘন্টা শক্ত কাঠের বেঞ্চে বসে শান্তির সপক্ষে, আণবিক বোমার বিরুদ্ধে তাঁর এই অবস্থান ধর্মঘট অব্যাহত রাখছেন।
সেই ১৯৮১ সাল থেকে, ২৭ বছর ধরে সারাক্ষণ!
০৩
কনশিতা যুক্তরাষ্ট্রে আসেন স্পেন দূতাবাসের কর্মী হিসাবে। বিয়ে হয় এক ইতালীয় ব্যবসায়ীর সাথে, ওলগা নামে একটি মেয়ের জন্মও হয়। কিন্তু এক সময় ভেঙে যায় কনশিতার সংসার, মেয়েকে হারান, চলে যায় চাকুরিটিও। মানসিক সমস্যা দেখা দেয় তাঁর, স্বামীর উপরে সন্দেহ রূপ নেয় অনেকটা অবসেশনে, আস্তে আস্তে মনে হতে থাকে সবাই তাঁর বিপক্ষে কাজ করছে, পুলিশ ও সন্দেহজনক সাদা পোশাকের মানুষেরা অনুসরণ করছে তাঁকে প্রতিনিয়ত। এভাবে আমেরিকা থেকে স্পেনে কিছু দিন কাটিয়ে কনশিতা ফিরে আসেন ফের আমেরিকাতে। এক সময় উপস্থিত হন হোয়াইট হাউজের দ্বারপ্রান্তে। নিজের ব্যক্তিগত প্রতিবাদ পালটে গেছে তখন দুনিয়ার সব দুঃখ, সব অনাচারের বিরূদ্ধে প্রতিবাদে, পরাশক্তির বিরূদ্ধে বিক্ষোভে। সদ্য পরিচিত টমাস নামের আরেক প্রতিবাদীর সাথে মিলে কনশিতা শুরু করে দেন আণবিক বোমার বিরুদ্ধে তাঁর প্রগাঢ় প্রতিবাদ।
সেটা ছিলো প্রেসিডেন্ট রেগানের শাসনামলের শুরু – সেই ১৯৮১ সাল।
রেগান চলে যান, আসেন বড় বুশ, তার পরে ক্লিনটন, এখন ছোট বুশ। রাজা আসে, রাজা যায়, কিন্তু কনশিতার প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। হোয়াইট হাউজের নাকের গোড়াতে এরকম উপস্থিতি সহ্য হয়নি পুলিশের ... তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয় পার্করক্ষী পুলিশ, ভেঙে দেয়া হয় কনশিতার ঝুপড়িটি। শুরুর দিকে হোয়াইট হাউজের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে প্রেসিডেন্টের বাড়ির মাত্র কয়েক ফুট দূরেই তৈরী হয়েছিলো ঝুপড়িটি, কিন্তু পুলিশ সেখানে থাকতে দেয়নি। আদালতের আশ্রয় নেন কনশিতা, ১৯৮৩ সালে আদালত রায় দেয়, হোয়াইট হাউজের দেয়ালের পাশের ফুটপাতে থাকা যাবে না। কনশিতা, আর তার সঙ্গী টমাস আশ্রয় নেন ফুট ত্রিশেক দূরে, রাস্তার অপর পারের পার্কে।
সেই পার্কের বেঞ্চ আর ঝুপড়িতে থাকতে তাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, ওখান থেকে সরলেই পুলিশ সব ভেঙে দেয় বার বার। তাই সেই সময় থেকে আজ অবধি কনশিতা শীত গ্রীষ্ম সব সময়েই ২৪ ঘণ্টা ওখানে বসে থাকেন। শুয়ে ঘুমাবার উপায়ও নেই ... ভবঘুরে বিরোধী আইনের অধীনে পার্কে কারো মাটিতে শুয়ে ঘুমানো মানা। তাই পুলিশের ঝামেলা এড়াতে বেঞ্চে বসে ঘুমানো অভ্যাস হয়ে গেছে কনশিতার। ওয়াশিংটনের বিভিন্ন রেস্তোঁরা থেকে পুরানো বাসি খাবার পাঠিয়ে দেয়া হয় প্রতিদিন, তাই খেয়ে বা অর্ধাহারে কেটে যায় কনশিতার দিনরাত্রি।
ঝুপড়ির চারিপাশে ছবি আর ছবি ... আণবিক বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হিরোশিমার কিশোরীর ছবি, দুনিয়ার সর্বত্র আণবিক বোমার সন্ত্রাসের বিরোধী প্রতিবাদী সব ছবি। এরই মাঝে ক্লান্ত চোখে বসে থাকেন কনশিতা।
২৭ বছরের প্রতিবাদ, এখনো শেষ হয়নি, প্রশান্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখার এ প্রতিবাদ, আজো অমলিন।
পাদটীকা
Friday, January 30, 2009
\ ভাষার ধর্ম | ধর্মের ভাষা /
জবাবে রসিক এক খেলোয়াড় বলেছিলেন, “কী যে বলেন দাদা, মোহামেডান হতে যাবো কেনো!! আমরা সবাই ভিক্টোরিয়ান”*।
এক বাঙালি জাতি, সেই চর্যাপদের আমল থেকে বাংলা বলতে বলতে কখন যেনো নিজের অজান্তেই ভাষাকে ভাগ করে ফেলেছে ধর্মীয় লেবাসে।
--
জল নাকি পানি, এই বিতর্ক এই ভেদাভেদ এখন প্রকট হয়ে গেছে পূর্ব আর পশ্চিমবঙ্গে, আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে মুসলিম প্রধান এবং হিন্দু প্রধান এলাকাতে। এক সময় অর্কুট নামের ব্যর্থ সোশাল নেটওয়ার্কের এক কমিউনিটির সদস্য ছিলাম, যার মূল প্রতিপাদ্য ছিলো (কাগজে কলমে), দুই বাংলার মিলন সাগর। কিন্তু ঘটিদের বাগে পেলে বাঙালেরা যেমন সাইজ করে, সেই কমিউনিটিতে হাতে গোনা দুই বাংলাদেশীর একজন হওয়াতে আমি হাড়ে হাড়ে টের পেলাম, উল্টোটাও সত্য। বাংলাদেশ = মুসলিম = সন্ত্রাসী এই ফরমুলাতে ধাতানী দেয়ার এক পর্যায়ে মস্তান দাদা যে থিওরি দিলেন, তা এরকম – বাংলাদেশের বাংলা আর বিশুদ্ধ বাংলা নেই, তা এখন উর্দুঘেষা বাংলাতে পরিণত হয়ে গেছে, যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই “জল” এর বদলে “পানি” বলে, যা নাকি খাস উর্দু থেকে চাপানো হয়েছে।
ঘটি পশ্চিমবঙ্গবাসীদের এই তত্ত্ব আগেও শুনেছি ... কেবল আমিই শুনেছি তা না, আমাদের বাঙাল গর্ব সুনীল গাঙ্গুলীকেও শুনতে হয়েছে বহুকাল। হাজার হলেও সুনীল ফরিদপুরের খাস বাঙাল, ৪৭ এর দেশ বিভাগের পরে যখন তাঁর স্থায়ী নিবাস কলকাতায়, তখন তাঁকেও “পানি” নিয়ে উপহাসের স্বীকার হতে হয়েছে। আত্মজীবনী “অর্ধেক জীবন” বইটাতে সুনীল “পানি” শব্দের এই “ধর্মীয় লেবাস” সম্পর্কে বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন, কেননা পানি শব্দটি আদতে সংস্কৃত মূল “পান্য” থেকে এসেছে বাংলাতে, তার পাশাপাশি হিন্দুস্থানীতে (ও তার অধুনা সন্তান হিন্দি ও উর্দুতে)। এক মূল সংস্কৃত ভাষা থেকে আসা জল হয়ে গেলো “খাঁটি বাংলা”, আর “পানি” হয়ে পড়লো “মুসলমানী (বিকৃত) বাংলা”, পশ্চিমবঙ্গে (এবং হয়তো পূর্ববঙ্গেও) প্রচলিত এই ধর্ম-শব্দ-ধারনার কারণ কী, সুনীল প্রশ্ন করেছেন সেখানে।
---
সুনীলের প্রশ্নটা আমাকেও ভাবায়, বাংলাতে আরবী শব্দ যে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ নির্বিশেষে সবাই ব্যবহার করেন না, তা নয়। “কাগজ”, “কলম”, এরকম আরবী শব্দ ব্যবহারে তো কারোরই কোনো আপত্তি নেই। নেই আপত্তি “আইন” শব্দটিতে, কিন্তু সংস্কৃত পানি শব্দটি কীভাবে হয়ে গেলো “মুসলমান”, আর জল হয়ে গেলো “হিন্দু”?
পারিবারিক সম্পর্কের শব্দগুলো চুড়ান্ত রকমের ধর্ম-ভিত্তিক, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সম্ভবত কেউই “আম্মা” বা “আব্বা” বলেননা, যেমন মুসলমানেরা বলেননা “পিসি”। পশ্চিমবঙ্গে সম্ভবত “ভাইয়া” শব্দটি সর্বত্র মুসলমান শব্দ বলেই বিবেচিত হয়, (গল্পে নাটকে মুসলমান চরিত্রগুলোর মুখেই আসে দেখি)। অথচ আরেকটু পশ্চিমে গেলেই হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সবাই ভাইয়া বলে চলে। ভাই শব্দটি কোথা থেকে এসেছে, অ-ভাষাবিদ আমার পক্ষে জোরসে বলা অত সহজ নয়, কিন্তু প্রায় নিশ্চিত যে সংস্কৃত “ভ্রাতঃ” শব্দ থেকেই এটা এসেছে, ইন্দো-ইয়ুরোপীয় সংযোগের সুবাদে যার ইংরেজি রূপ “ব্রাদার”। তাহলে ভাইয়া কেনো মুসলমান আর দাদা হলো হিন্দু?
বাংলার এই ধর্মীয় শব্দভেদ তাহলে এলো কীভাবে? বাংলার পশ্চিমের এলাকাগুলো সব সময়ে যে মুসলিম শাসকদের অধীনে ছিলো, তাও নয়, বরং বাংলার চাইতে ভারতের সেই সব এলাকায় মোগল পাঠান শাসকদের শাসন চলেছে অনেক বেশি। খোদ বাংলাদেশ তথা পূর্ববঙ্গেও সর্বত্র মুসলিম শাসন ছড়িয়ে যায় নি, তার পরেও কেনো পূর্ববঙ্গের ভাষায় তথাকথিত “মুসলিম” বাংলার আধিক্য, যেখানে পশ্চিমবঙ্গে তথাকথিত “শুদ্ধ” শব্দের ব্যাপকতা বেশি?
--
কলকাতার সেই হোটেল মালিক জল আর পানিতে ধর্ম চিনতে চেষ্টা করেছিলেন। দাদা আর ভাই, জল আর পানি, -- কেমন করে যেন বাংলা শব্দগুলো চাপা পড়েছে ধর্মের লেবাসে, তাই গোসল আর স্নানে, নিমন্ত্রণ আর দাওয়াতে আমরা চিনে নেবার চেষ্টা করি মানুষের ধর্মীয় পরিচয়, এক লহমায় ফেলে দেই স্টেরিওটাইপে। সেই স্টেরিওটাইপ আমাদের মন মানসে নিয়ে আসে মরিচ, কিংবা স্থানভেদে লংকার ঝাল, কিংবা লবন অথবা নুনের মতো স্বাদ।
-----------------------------
[পাদটীকা ১] ভাষার উপরে উপরের লেখাটিতে বিস্তর “সম্ভবত” ব্যবহার করা হয়েছে, কারণ অনেকটাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। কুপমন্ডুক হিসাবে আমার দৃষ্টিসীমা একটু সীমাবদ্ধ, কাজেই অনেক শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে ধারণাটিও সেরকম। দয়া করে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখবেন।
[পাদটীকা ২] সেই সময়ে ঢাকার দুই বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব ছিলো মোহামেডান আর ভিক্টোরিয়া
[পাদটীকা ৩] বাংলা উইকিতে এই সংক্রান্ত ঝামেলা বাঁধার আগেই আমরা ভাবছি, ব্রিটিশ-আর-আমেরিকান বানানের/শব্দের মতো রীতিটা হয়তো বেছে নিবো। অর্থাৎ কেউ একটা বানান/শব্দ বেছে নিয়ে নিবন্ধ শুরু করলে সেটা "ঠিক" করার চেষ্টা হবে না, আর এলাকা ভিত্তিক বিষয়বুঝে শব্দ/বানান ব্যবহার করা হবে। দেখা যাক, এই ব্যাপারে শেষমেশ কী ঠিক করা চলে।