০১
কম্পিউটার নিরাপত্তার উপরে সবচেয়ে বড় কনফারেন্সের একটি হলো এসিএম সিসিএস - প্রতিবছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির উপকণ্ঠের আলেক্সান্দ্রিয়াতে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এই কনফারেন্সের উপলক্ষেই ২০০৬ এর শরতে ওখানে আমাদের যাওয়া। কনফারেন্স শেষে একটা দিন হাতে রেখেছিলাম, আমি আর আমার স্ত্রী জারিয়া ওয়াশিংটন শহরটা ঘুরে দেখার জন্য।
পুরো শহরের সুরম্য সব অট্টালিকা আর মনুমেন্ট দেখে দেখে শরতের সেই রোদেলা বিকেলে চলে আসি মার্কিন রাষ্ট্রপতির সরকারী বাসস্থান হোয়াইট হাউজের পাশে। দুনিয়ার একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ভবনের চারপাশে অবশ্য দৃশ্যমান নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি নেই। বাংলাদেশে যেমন রাষ্ট্রপতির বাসভবনের ধারে কাছে কাক পক্ষীকেও ঘেঁষতে দেয়না পুলিশের ব্যুহ, তেমনটা দেখা যাচ্ছেনা। চারিদিকে পর্যটকদের ভিড়, হোয়াইট হাউজের একেবারে দেয়াল ঘেঁষে এমনকি দেয়ালের ফাঁক দিয়ে ক্যামেরা গলিয়ে চটাপট ছবি তুলছে সবাই।
জারিয়া আর আমি হোয়াইট হাউজের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকি, ভাবি এই নিতান্তই সাধারন চেহারার ভবনে দুনিয়া পালটে দেয়া ভালো মন্দ কতো সব ঘটনার সূচনা হয়, কতো কিছুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। হোয়াইট হাউজের বিশাল পরিধি ঘুরে আসতে আসতে এসে যাই পেছনের দিকে, পেছনেই রয়েছে এক চিলতে জমিতে করা ছোট্ট একটা পার্ক। অন্য সব ট্যুরিস্টের সাথে আমরাও ছবি তুলতে থাকি, শক্তিমান রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রাণকেন্দ্রের স্মৃতি ধরে রাখতে।
এমনি সময় আমার চোখ পড়ে পেছনের সেই পার্কটির দিকে। হোয়াইট হাউজের সীমানা প্রাচীর, তার পাশে একফালি রাস্তার ঠিক পরেই, ফুট পচিশেক দূরত্বে লাফায়েত স্কয়ার নামের পার্কের সীমানা। সেই সীমানার শুরুতেই এক বেঞ্চ আর তার পাশে রঙ্গীলা এক ছাউনি তৈরী করে বসে থাকতে দেখি প্রৌঢ়া এক রমণীকে। যুক্তরাষ্ট্রের বহু শহরে ঘোরার অভিজ্ঞতা থাকায় গৃহহীন মানুষের দেখা পেয়েছি বিস্তর, কিন্তু বিস্মিত হই খোদ হোয়াইট হাউজের পাশেই গৃহহীন ভিক্ষুকের বসতি দেখে। “দেশের সবার কাছে গল্প করা যাবে”, তা ভেবে পটাপট ছবি তুলে নেই ক্লান্ত চোখে চেয়ে থাকা এই রমণীর। তার পর ভুলে যাই তাঁর কথা ... সুরম্য ভবন আর সমাধির চাকচিক্যে হারিয়ে যায় সেই রমণীর কাতর দৃষ্টির স্মৃতি।
০২
আরবানাতে ফিরে যাই, কাজে কর্মে ব্যস্ত হয়ে মনে থাকেনা ছবিটির কথা। মাসখানেক পরে এক অলস দুপুরে ল্যাপটপের পর্দায় ছবিটা আবার ভেসে আসে, অকস্মাৎ কৌতুহল জেগে উঠে মনে। গুগলে খুঁজতে থাকি, কে এই রমণী, কীভাবে রাষ্ট্রপতি ভবনের পাশেই রয়েছে তাঁর বসতি। পরিচয়টা যখন জানতে পারি, অবাক বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে থাকি কিছুক্ষণ।
ক্লান্ত নয়নের এই প্রৌঢ়া রমণীর নাম কনসেপশন পিচ্চিওত্তো। বন্ধুদের কাছে কনশিতা বা কনি নামে পরিচিত কনসেপশনের জন্ম স্পেনে, ১৯৪৫ সালে। পরাক্রমশালী মার্কিন রাষ্ট্রপতির যেখানে বাস, সেই হোয়াইট হাউজের পেছনের লাফায়েত স্কয়ার পার্কে বসে কনশিতা নীরব প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন, পথকে নিজের ঘর বানিয়ে দিনরাত ২৪ ঘন্টা শক্ত কাঠের বেঞ্চে বসে শান্তির সপক্ষে, আণবিক বোমার বিরুদ্ধে তাঁর এই অবস্থান ধর্মঘট অব্যাহত রাখছেন।
সেই ১৯৮১ সাল থেকে, ২৭ বছর ধরে সারাক্ষণ!
০৩
কনশিতা যুক্তরাষ্ট্রে আসেন স্পেন দূতাবাসের কর্মী হিসাবে। বিয়ে হয় এক ইতালীয় ব্যবসায়ীর সাথে, ওলগা নামে একটি মেয়ের জন্মও হয়। কিন্তু এক সময় ভেঙে যায় কনশিতার সংসার, মেয়েকে হারান, চলে যায় চাকুরিটিও। মানসিক সমস্যা দেখা দেয় তাঁর, স্বামীর উপরে সন্দেহ রূপ নেয় অনেকটা অবসেশনে, আস্তে আস্তে মনে হতে থাকে সবাই তাঁর বিপক্ষে কাজ করছে, পুলিশ ও সন্দেহজনক সাদা পোশাকের মানুষেরা অনুসরণ করছে তাঁকে প্রতিনিয়ত। এভাবে আমেরিকা থেকে স্পেনে কিছু দিন কাটিয়ে কনশিতা ফিরে আসেন ফের আমেরিকাতে। এক সময় উপস্থিত হন হোয়াইট হাউজের দ্বারপ্রান্তে। নিজের ব্যক্তিগত প্রতিবাদ পালটে গেছে তখন দুনিয়ার সব দুঃখ, সব অনাচারের বিরূদ্ধে প্রতিবাদে, পরাশক্তির বিরূদ্ধে বিক্ষোভে। সদ্য পরিচিত টমাস নামের আরেক প্রতিবাদীর সাথে মিলে কনশিতা শুরু করে দেন আণবিক বোমার বিরুদ্ধে তাঁর প্রগাঢ় প্রতিবাদ।
সেটা ছিলো প্রেসিডেন্ট রেগানের শাসনামলের শুরু – সেই ১৯৮১ সাল।
রেগান চলে যান, আসেন বড় বুশ, তার পরে ক্লিনটন, এখন ছোট বুশ। রাজা আসে, রাজা যায়, কিন্তু কনশিতার প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। হোয়াইট হাউজের নাকের গোড়াতে এরকম উপস্থিতি সহ্য হয়নি পুলিশের ... তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয় পার্করক্ষী পুলিশ, ভেঙে দেয়া হয় কনশিতার ঝুপড়িটি। শুরুর দিকে হোয়াইট হাউজের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে প্রেসিডেন্টের বাড়ির মাত্র কয়েক ফুট দূরেই তৈরী হয়েছিলো ঝুপড়িটি, কিন্তু পুলিশ সেখানে থাকতে দেয়নি। আদালতের আশ্রয় নেন কনশিতা, ১৯৮৩ সালে আদালত রায় দেয়, হোয়াইট হাউজের দেয়ালের পাশের ফুটপাতে থাকা যাবে না। কনশিতা, আর তার সঙ্গী টমাস আশ্রয় নেন ফুট ত্রিশেক দূরে, রাস্তার অপর পারের পার্কে।
সেই পার্কের বেঞ্চ আর ঝুপড়িতে থাকতে তাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, ওখান থেকে সরলেই পুলিশ সব ভেঙে দেয় বার বার। তাই সেই সময় থেকে আজ অবধি কনশিতা শীত গ্রীষ্ম সব সময়েই ২৪ ঘণ্টা ওখানে বসে থাকেন। শুয়ে ঘুমাবার উপায়ও নেই ... ভবঘুরে বিরোধী আইনের অধীনে পার্কে কারো মাটিতে শুয়ে ঘুমানো মানা। তাই পুলিশের ঝামেলা এড়াতে বেঞ্চে বসে ঘুমানো অভ্যাস হয়ে গেছে কনশিতার। ওয়াশিংটনের বিভিন্ন রেস্তোঁরা থেকে পুরানো বাসি খাবার পাঠিয়ে দেয়া হয় প্রতিদিন, তাই খেয়ে বা অর্ধাহারে কেটে যায় কনশিতার দিনরাত্রি।
ঝুপড়ির চারিপাশে ছবি আর ছবি ... আণবিক বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হিরোশিমার কিশোরীর ছবি, দুনিয়ার সর্বত্র আণবিক বোমার সন্ত্রাসের বিরোধী প্রতিবাদী সব ছবি। এরই মাঝে ক্লান্ত চোখে বসে থাকেন কনশিতা।
২৭ বছরের প্রতিবাদ, এখনো শেষ হয়নি, প্রশান্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখার এ প্রতিবাদ, আজো অমলিন।
পাদটীকা
No comments:
Post a Comment