Monday, June 25, 2007

ভাষার কড়চা - ২

উইকিপিডিয়া নিয়ে কাজ করতে করতে একদিন একটা মূদ্রা দেখে চমকে গেলাম। মূদ্রাটি দশম শতকের, এবং শ্রীলংকার চোল রাজবংশের রাজা উত্তম চোলের শাসনামলে চালু করা মূদ্রা।

তবে আমার চমকে যাওয়ার কারণটা অন্য। মূদ্রার গায়ে উত্তম চোলের নাম লেখা আছে, বাংলা হরফে!! শ্রীলংকায় কীভাবে গেলো এই বাংলা লেখা? উত্তম চোলের শাসনামল ৯৭০ হতে ৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ অবধি। চোল রাজবংশ ছিলো দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলংকার অধিপতি, ১৩শ শতক পর্যন্ত এদের রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিলো মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, সুমাত্রা ও বালি দ্বীপেও।

যাহোক, এদের মূদ্রায় বাংলা এলো কী করে?

এই প্রশ্ন রেখেছিলাম উইকিপিডিয়ান সামীরুদ্দৌলা খানের কাছে, যিনি ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট লস অ্যাঞ্জেলেসে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি করছেন। মূদ্রাটা দেখে আমার মতো উনিও চমকে গিয়েছিলেন প্রথমে। পরে বেশ খোঁজাখুজি করে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন।

আসলে বাংলা হরফের উদ্ভব হয়েছে নাগরী লিপি হতে। নাগরী লিপির উদ্ভব হয় প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মী লিপি হতে। সংস্কৃত লেখা হতো ব্রাহ্মী লিপিতে। নাগরী লিপির এক শাখাতে রয়েছে বাংলা হরফ, যা অসমীয়া ও বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরী ভাষা লেখাতেও ব্যবহৃত হয়। এই শাখার নাম হলো পূর্ব-নাগরী লিপি।

আর অন্য শাখায় রয়েছে দেবনাগরী। আধুনিক সময়ে হিন্দি, মারাঠি, সংস্কৃত, নেপালী ইত্যাদি ভাষা লেখায় এই হরফ ব্যবহৃত হয়।

সামীরের ব্যাখ্যা হলো, ১০ম শতকের দিকে তৈরী করা এই মূদ্রাতে আসলে নাগরী লিপির এক আদি রূপ দেখতে পাচ্ছি। নাগরী লিপি তখনো পূর্বীয় আর দেবনাগরী - এতো বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে যায় নি। চর্যাপদের কথা মনে আছে? বাংলা ভাষার প্রাচীনতম লিখিত নিদর্শন এই চর্যাপদ লেখা হয়েছিলো ৮ম হতে ১১শ শতকের মধ্যে। একই সময়ে চোল রাজবংশের ব্যবহার করা ভাষাতেও এই নাগরী হরফ ব্যবহার করা হয়েছিলো।

যাহোক, ব্যাখ্যাটা নাহয় পাওয়া গেলো, কিন্তু তার পরেও, আধুনিক বাংলা লিপির সাথে এই মূদ্রাটার এতো প্রচন্ড মিল যে, চমকে যেতে হয়।

প্রাচীন ভারতের অনেক লিপির পাঠোদ্ধার আজো হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে হরপ্পা, মহেঞ্জোদারোর দূর্বোধ্য শিলালিপি। মিশরের হায়েরোগ্লিফিকের কথা মনে পড়তে পারে, উনবিংশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ওটাও দূর্বোধ্য ছিলো। নেপোলিয়ন মিশর জয়ের জন্য যখন অভিযান পাঠান, তাঁর সেনাবাহিনীর সাথে কিছু ভাষাবিদও পাঠিয়েছিলেন। এদের একজন, ক্যাপ্টেন পিয়েরে ফ্রাঁসোয়া বুচার্দ মিশরের রশীদ নামের শহরে খুজে পান একটা শিলালিপি, যার নাম দেয়া হয় রোসেট্টা স্টোন (শহরের ফরাসী/ইংরেজি নাম রোসেট্টা হতে)। তার পাঠোদ্ধার করেন ভাষাবিদ জাঁ ফ্রাঁসোয়া শাঁপোলিও, ১৮২২ সালে।

পাঠোদ্ধার করলেন কীভাবে? আসলে ঐ শিলালিপিতে হায়েরোগ্লিফিকের (চিত্রলেখ) পাশাপাশি ডেমোটিক ও পুরানো গ্রীক ভাষাতেও একই কথা লেখা ছিলো। লেখা মিলিয়ে মিলিয়ে শাঁপোলিও হায়েরোগ্লিফিকের ছবিগুলোর অর্থ বোঝার পদ্ধতি বের করেন।

কিন্তু আজো হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর লেখাগুলোর পাঠোদ্ধারের জন্য ওরকম কিছু পাওয়া যায় নি। তাই ভারতের আদি ঐ সভ্যতার কথা, তাদের জীবনকাহিনী রয়ে গেছে অজানাই।

No comments: