৩য় জহুরুল হক – আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন স্মারক বিজ্ঞান বক্তৃতামালা
উইকিপিডিয়াঃ জনমানুষের বিশ্বকোষ
রাগিব হাসান
পিএইচডি গবেষক, কম্পিউটার বিজ্ঞান
ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় অ্যাট আর্বানা শ্যাম্পেইন
প্রশাসক ও নীতিনির্ধারক, বাংলা উইকিপিডিয়া
www.ragibhasan.com
পিএইচডি গবেষক, কম্পিউটার বিজ্ঞান
ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় অ্যাট আর্বানা শ্যাম্পেইন
প্রশাসক ও নীতিনির্ধারক, বাংলা উইকিপিডিয়া
www.ragibhasan.com
ভূমিকা ও ধন্যবাদ
আসসালামু আলাইকুম। সুধীবৃন্দ, জহুরুল হক ও আব্দুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন বার্ষিক বিজ্ঞান বক্তৃতামালার ৩য় আয়োজনে আমাকে বক্তব্য রাখতে দেয়ার জন্য শুরুতেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতিকে। সেই সাথে এই অনুষ্ঠানে আসার জন্যও আপনাদেরকে জানাচ্ছি অশেষ ধন্যবাদ।
আমি পেশায় ও নেশায় একজন কম্পিউটার প্রযুক্তিবিদ। তাই আমার বক্তব্যের মধ্যে এসে যায় কম্পিউটার ও কারিগরি সব কথামালা। কিন্তু আজ আমি প্রযুক্তির খটোমটো বিষয় নয়, বরং আমাদের জীবনের তাগিদে, আমাদের মনের তাগিদে এই প্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করবো। আজকে আমার বক্তৃতার বিষয় হলো, জনমানুষের বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়াকে নিয়ে।
জীবনের জন্য বিজ্ঞানচর্চা
অনেক দিন আগে প্রফেসর মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখায় একটা কথা আমার খুব ভালো লেগেছিলো। হুবুহু মনে নেই, তবে তার মোদ্দা কথা হলো, যে বিজ্ঞান জীবনের কাছাকাছি, সেটাই প্রকৃত বিজ্ঞান। যে বিজ্ঞান আমাদের জীবনের তাগিদে, জীবনের সুখ দুঃখ, আশা আকাংক্ষা, ইতিহাস, ঐতিহ্যের প্রয়োজন মেটায়, সেটাই যথার্থ বিজ্ঞান।
আজকের বিশ্বটা তথ্যপ্রযুক্তির জোয়ারে ভাসছে। ইমেইল, ইন্টারনেট, এসএমএস, ৪র্থ প্রজন্মের মোবাইল ফোন – এসব প্রযুক্তি আজ পৌছে গেছে সারা বিশ্বের দুয়ারে দুয়ারে। বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতই আমাদের জীবনের প্রতিটি অংশে অংশে আমরা পাচ্ছি এসব প্রযুক্তির ছোঁয়া। কিন্তু এই সব প্রযুক্তির শুধু ভোক্তা না হয়ে জীবনের জন্য, আমাদের ইতিহাসের জন্য, আমাদের শতবছরের জ্ঞানের যথাযথ সংরক্ষণের জন্য এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। আর এই তথ্যাবলী একসাথে করার কাজের জন্য আমাদের প্রয়োজন তথ্যের সমন্বিত সংকলন বা বিশ্বকোষ রচনা করা।
তথ্য পাওয়ার সার্বজনীন অধিকার
জীবনে এগিয়ে যেতে হলে বিজ্ঞানচর্চার কোনোই বিকল্প নেই। কিন্তু এ জন্য চাই তথ্য, আর সেই তথ্যকে মুক্ত ভাবে লাভ করা ও ব্যবহার করার অধিকার। তথ্য লাভের অধিকার সার্বজনীন ও মৌলিক অধিকার। এটা সুনিশ্চিত করতে হলে আমাদের জীবন, শিক্ষা, বিজ্ঞান – এ সব কিছুর সমন্বিত সংকলন সৃষ্টি করতে হবে, আর তাতে সবার সর্বাত্মক প্রবেশাধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্বকোষের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
জ্ঞান-বিজ্ঞানকে একসাথে জড়ো করে রাখার প্রচেষ্টা কিন্তু আজকের নয়। সেই হাজার বছর আগে থেকেই জ্ঞানী বিজ্ঞানীরা এভাবে লিখে আসছেন বিশ্বকোষ। আজ থেকে প্রায় দুই হাজারেরও বেশি বছর আগে অ্যারিস্টোটল লিখেছিলেন বিশ্বকোষ। তাঁর পর ইতিহাসবিদ প্লিনি লিখেন ৩৭ খন্ডে এক বিশাল বিশ্বকোষ। ৯ম শতকে এরকম একটি বিশ্বকোষ তৈরীর কাজ করেন চীনা পন্ডিতরা। মুসলিম বিজ্ঞানী আবু বকর আল রাযী লিখেন বিজ্ঞানের বিশ্বকোষ। ইবনে সিনা লিখেছেন চিকিৎসার বিশ্বকোষ। অষ্টাদশ শতকে ফরাসি দার্শনিকেরা ২৯ বছর চেষ্টা করে লিখেন একটি বিশ্বকোষ। তার জবাবে ১৭৬৮ সালে স্কটল্যান্ডে অনেক জন বিশেষজ্ঞের প্রচেষ্টায় ব্রিটেনে তৈরী হয় এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার প্রথম সংস্করণ, ৩ খন্ডে।
বাংলা ভাষায় প্রথম বিশ্বকোষ রচনা করা হয় সেই উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে, নরেন্দ্রনাথ বসুর হাতে। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলাদেশের এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্যোগে ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরী হয় বাংলা ভাষার বিশ্বকোষ বাংলাপিডিয়া, যা মূলত বাংলাদেশ ও অখন্ড বাংলার উপরেই জোর দিয়েছে। তবে এতে বিশ্বের অন্যান্য অংশের সম্পর্কে এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার তথ্য নেই। তাই বর্তমানে বাংলায় পূর্ণাঙ্গ একটি তথ্যভান্ডারের বড়ই অভাব। আমাদের দেশের মানুষের পক্ষে লাখ টাকার বিদেশী বিশ্বকোষ কেনাটা সম্ভব না। আর ইংরেজিতে লেখা নিবন্ধ পড়ে অনুধাবন করাটাও আপামর মানুষের জন্য খুব সহজ না। জনমানুষের কাছে সারা বিশ্বের সব জ্ঞান ও তথ্য পৌছে দিতে হলে আমাদের দরকার আধুনিক প্রযুক্তির সর্বাত্মক ব্যবহার, আর তা করতে হবে মাতৃভাষাতেই।
এ তো গেলো বিশ্বকোষের ইতিকথা। এবার দেখা যাক তথ্য প্রযুক্তি কিভাবে এতে সাহায্য করতে পারে।
ইন্টারনেটে উইকি প্রযুক্তির ইতিহাস
ষাটের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারগুলি হতে তৈরী হওয়া ইন্টারনেট ব্যাপক ভাবে বিস্তৃত হয় নব্বই এর দশকের গোড়ায়। আর এসময়ই তৈরী হয় ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের মতো প্রযুক্তি, যা তথ্যকে বিশ্বজুড়ে সবার নখদর্পনে এনে দেয়। তবে, গোড়ার দিকের সব ওয়েবপেইজই ছিলো শুধুমাত্র পড়ার উপযোগী। অর্থাৎ ওয়েব পেইজগুলির পাঠকেরা শুধুই পড়তে পারবেন, কোনো পরিবর্তন করতে পারতেন না। একমূখী এই ওয়েবপেইজগুলো তাই বিশ্বজুড়ে যৌথভাবে কাজ করায় খুব একটা সহায়তা করতে পারেনি।
এই ব্যাপারটাকে পাল্টানোর জন্য কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদেরা চেষ্টা শুরু করেন। ওয়ার্ড কানিংহাম নামের একজন প্রোগ্রামার প্রথম এরকম সফটওয়ার তৈরী করেন। তিনি এর নাম দেন উইকি। এই শব্দটি এসেছে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের ভাষার শব্দ উইকিউইকি হতে, যার অর্থ দ্রুত ভাবে ছুটে যাওয়া। খুব দ্রুততার সাথে উইকিপ্রযুক্তির ওয়েবপেইজকে পাল্টানো যায়, তাই এই নামকরণ। উইকি প্রযুক্তির আরেকটা লক্ষ্য ছিলো ওয়েবপেইজ তৈরীকে অনেক সহজ করে দেয়া, এইচটিএমএল বা অন্যান্য ওয়েবপেইজ ডিজাইনের ভাষার মতো এটা অতো জটিল না, বরং এতে লেখার চেহারার চাইতে মূল বিষয়বস্তুর উপরেই বেশী জোর দেয়া হয়েছে।
উইকি প্রযুক্তির মূলে রয়েছে উইকি সফটওয়ার, যা সার্ভারে দেয়া থাকে। এটি থাকার ফলে উইকিপ্রযুক্তি ভিত্তিক ওয়েব পেইজ গুলিকে সম্পাদনা করা যায় পৃথিবীর যেকোনো খান থেকেই। ফলে একই ডকুমেন্টের উপরে কাজ করতে পারেন হাজার হাজার মানুষ, যা অন্য কোনো প্রযুক্তির চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপক। এছাড়া পুরনো যেকোনো সংস্করণে ফেরত যাওয়া যায় খুব সহজেই। তাই অযাচিত যেকোনো সম্পাদনাকে সহজেই পাল্টে সঠিক সংস্করণে ফেরত যাওয়া যায়।
উইকিপিডিয়ার সূচনা
উইকি প্রযুক্তির বিস্তার ঘটলেও এর ব্যবহার মূলত সীমাবদ্ধ ছিলো বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারে। বিশ্বকোষে এটি ব্যবহার করার কথা কারো মাথায় আসেনি শুরুতে।
২০০০ সালের দিকে জিম ওয়েলস নামে এক জন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা একটি বিশ্বকোষ তৈরীর উদ্যোগ নেন। এর নাম দেয়া হয় নুপিডিয়া (NuPedia)। এটা অবশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য স্থানের শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় তৈরীর কথা ছিলো। কিন্তু এক বছর অতিবাহিত হলেও দেখা গেলো যে, মাত্র গোটা বিশেকের বেশি নিবন্ধ শুরু করা যায় নি। ২০০১ সালে জিম্বো ওয়েলসের সহযোগী ল্যারি স্যাঙ্গার তাঁকে পরামর্শ দেন যে, উইকি প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি পুরাপুরি উন্মুক্ত বিশ্বকোষ তৈরী করার জন্য। শুরুতে কেউ ভাবতেই পারেনি এটা আসলে সম্ভব। কিন্তু অল্প কিছু দিনের মধ্যেই হাজার কয়েক নিবন্ধ তৈরী হয়ে গেলো। তাই উইকিপিডিয়ার আত্ম প্রকাশ ঘটলো ইংরেজি ভাষায়।
মুক্ত সোর্স
উইকিপিডিয়ার এই অভাবনীয় সাফল্যের মূলে রয়েছে জনমানুষের উপরে বিশ্বাস। আগে ধারণা ছিলো যে, বিশ্বকোষ লেখাটা শুধুই বিশেষজ্ঞদের কাজ। কিন্তু আপামর জনতার কাছে যে তথ্য আছে, বংশ পরম্পরায় এক প্রজন্ম হতে পরের প্রজন্মে মৌখিক বা সামাজিক ভাবে যে তথ্য স্থানান্তরিত হয়, তা এক সাথে সংকলিত করে এক জ্ঞানের মহাসাগর প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। উইকিপ্রযুক্তি সারা বিশ্বের মানুষকে এই সহযোগিতার সুযোগটা করে দিয়েছে। লাখ লাখ মানুষ ইন্টারনেটের মাধ্যমে উইকিপিডিয়া পড়া, ও এক সাথে মিলে মিশে সহযোগিতা করার মাধ্যমে গোষ্ঠিগত জ্ঞানকে সামগ্রিক সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পেরেছে।
উইকিপিডিয়ার প্রতিটি নিবন্ধেই সম্পাদনা করার ব্যবস্থা আছে। তাই যে কেউ, ইন্টারনেটের মাধ্যমে মূহুর্তেই যে কোনো নিবন্ধে তথ্য যোগ করতে পারেন। সাধারণত নিবন্ধগুলো শুরু হয় দুই এক লাইনের কথামালা নিয়ে। ইন্টারনেটে গুগল বা ইয়াহু অনুসন্ধানের প্রথম পাতাতেই এসব নিবন্ধের লিংক চলে আসে। এভাবেই হোক বা অন্য যে কোনো ভাবে নিবন্ধটি পড়তে গিয়ে যদি কারো মনে হয় যে, নিবন্ধটিতে কিছু তথ্য যোগ বিয়োগ বা পরিমার্জনা করা দরকার, সেটা দুই একটি ক্লিক করেই করে ফেলা সম্ভব। এটা খুব বড় একটা সুবিধা --- কারণ ব্রিটানিকা বা এনকার্টার মতো অন্যান্য বিশ্বকোষগুলো পড়তে গিয়ে ভূল তথ্য পেলেও সেটা ঠিক করে অপেক্ষা করতে হয় পরবর্তী সংস্করণের জন্য। আর উইকিপিডিয়ায় সেটা করা যায় সাথে সাথেই। যেমন, ২০০৪ সালের ভারত মহাসাগরীয় সুনামী সংঘটিত হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সেটার উপরে তথ্যবহুল নিবন্ধ যোগ করে ফেলেন উৎসাহী উইকিপিডিয়ানেরা। সে তুলনায় ব্রিটানিকা ও এনকার্টার মতো বিশ্বকোষের ইন্টারনেট সংস্করণেও সে তথ্য আসতে সময় লাগে বেশ অনেক দিন। আর ছাপা সংস্করণে তো সেটা আসতে পরের বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।
উইকিপিডিয়া হলো জনমানুষের বিশ্বকোষ। এটা শুধু জনমানুষের লেখাই না, বরং এটার সব তথ্য, সব ছবি ও অন্যান্য বিষয় প্রদান করা হয় মুক্ত কপিরাইট লাইসেন্সের অধীনে। এধরণের দুইটি লাইসেন্স হলো জিএফডিএল ও ক্রিয়েটিভ কমন্স। এসব লাইসেন্সে ছাড়া হয় বলে উইকিপিডিয়ার তথ্যাবলী ও নিবন্ধসমূহ যে কেউ যে কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারেন। চাইলে এটা ছেপে দিলেও সমস্যা নাই। শুধু উল্লেখ করলেই চলবে যে, এই নিবন্ধ বা ছবিটি উইকিপিডিয়া হতে নেয়া। আসলে তথ্য বা জ্ঞানের তো কোনো মালিকানা নেই, জ্ঞান সকলের জন্যেই। তাই জ্ঞানকে কপিরাইট বা মেধাসত্ত্ব লাইসেন্স দিয়ে বেঁধে না রেখে উইকিপিডিয়ার সব কিছুকেই মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।
আর মুক্ত করে দেয়া হয়েছে বলেই রয়েছে অনেক নিয়ম – উইকিপিডিয়াতে কোনো কপিরাইট যুক্ত লেখা এখান সেখান থেকে নিয়ে যোগ করা যাবে না। ছবির ক্ষেত্রে আরো কড়া কড়ি। শুধুমাত্র মুক্ত লাইসেন্সে দেয়া যায়, বা কপিরাইটের মেয়াদ শেষ হয়েগেছে, এমন ছবিই যোগ করা যাবে উইকিপিডিয়াতে।
উইকিপিডিয়ার তথ্য – কত ভাষা, কতটি নিবন্ধ
২০০১ সালে প্রথমে শুধু ইংরেজি ভাষায় উইকিপিডিয়া শুরু করা হয়। পরে একে একে জার্মান, স্প্যানিশ, ফরাসি, জাপানি সহ অন্যান্য অনেক ভাষায় এর সংস্করণ চালু করা হয়। বর্তমানে মোট ২৫০টি বিভিন্ন ভাষায় উইকিপিডিয়ার সংস্করণ আছে।
ইংরেজি উইকিপিডিয়াতে মোট নিবন্ধের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যায় ২০০৫ সালেই। আর বর্তমানে এর নিবন্ধ সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ১৫ লাখ, যা এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ২০গুন। এর মধ্যে ১২০০ নিবন্ধকে বলা হয় ফীচার নিবন্ধ বা নির্বাচিত নিবন্ধ, যাদের মান উইকিপিডিয়ার অন্য সব নিবন্ধের চেয়ে অনেক বেশি। এই নিবন্ধ গুলি নির্বাচনের অনেক মাপকাঠি আছে, সেই মাপকাঠি অনুযায়ী যাচাই বাছাই করে, নির্দিষ্ট গুণগত মানসম্পন্ন হলেই এদেরকে নির্বাচিত নিবন্ধ বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
কারা লিখছেন
বিশ্বকোষ হিসাবে উইকিপিডিয়ার খুব বড় একটা সুবিধা আছে। যেমন, ব্রিটানিকা বা এনকার্টার পক্ষে খুব বেশি হলে হাজার কয়েক বিশেষজ্ঞকে একত্র করা সম্ভব। কিন্তু উইকিপিডিয়া ইন্টারনেট ভিত্তিক হওয়াতে সারা বিশ্বের অজস্র মানুষ এটাতে কাজ করতে পারেন। ইংরেজি উইকিপিডিয়াতে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন, এমন উইকিপিডিয়ানের সংখ্যা ১ লাখের উপরে।
কেন লিখছেন মানুষ এই বিশ্বকোষ? এতে তো আর কারো কাছ থেকে অর্থ উপার্জন করা যাচ্ছেনা, কেউ লেখার সত্ত্বও পাচ্ছেন না। তবে তার পরেও মানুষ লিখছে। এর কারণটা নানাবিধ – কেউ লিখেন লেখার আনন্দে, কেউ লিখছেন নিজের গবেষণালব্ধ জ্ঞান নিয়ে, কেউ বা আবার নিজের দেশের ভাষা ইতিহাস ঐতিহ্যকে নিয়ে।
বিশ্বকোষ লেখার নিয়ম কানুন
উইকিপিডিয়ায় যেহেতু জানা অজানা অনেক মানুষ যেকোনো নিবন্ধ সম্পাদনা করতে পারে, তাই এর গুণগত মান ও তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে নজর রাখার দরকার হয় সব সময়। এই ব্যাপারগুলো নিশ্চিত করতে উইকিপিডিয়াতে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে বেশ কিছু নীতিমালা নেয়া হয়েছে, যেমন
• নির্ভরযোগ্যতা: সব তথ্য যাচাইযোগ্য হতে হবে, অর্থাৎ কেউ কোনো নতুন তথ্য যোগ করলে সেই তথ্যটির উৎস নির্দেশ করতে হবে। তথ্যসূত্র হতে হবে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রকাশনা, বই, বা জার্নাল হতে।
• নিরপেক্ষতা: উইকিপিডিয়াতে কোনো মতামত প্রকাশ করা হবে না, বরং সূত্র উল্লেখপূর্বক তথ্য প্রকাশ করা হবে। প্রতিটি তথ্য প্রকাশ করতে হবে নিরপেক্ষভাবে, যাতে করে কারো ব্যক্তিগত মনোভাব প্রকাশ না পায়।
• মেধাসত্ত্ব: উইকিপিডিয়ায় যোগ করা প্রতিটি বাক্য হবে মুক্ত, অন্য কোনো বই বা ওয়েবসাইট হতে বিনা অনুমতিতে লেখা বা ছবি যোগ করা যাবে না।
এ ছাড়াও লেখা লেখি করতে হলে লিখতে হবে বিশ্বকোষীয় ধাঁচে, একটু রসকষহীন ভাবে।
বাংলা উইকিপিডিয়ার কথা
বাংলা উইকিপিডিয়ার সূচনা হয় ২০০৪ সালেই, কিন্তু প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা সহ নানা কারণে এর বিকাশ হয়নি ততটা। বাংলাসহ অন্যান্য ভাষাকে ওয়েবপেইজে লেখার জন্য উইকিপিডিয়ায় ব্যবহার করা হয় ইউনিকোড পদ্ধতি। এই ইউনিকোডে বাংলা প্রদর্শন করা ও লেখার জন্য শুরুতে যথাযথ সফটওয়ারের অভাব ছিলো। আস্তে আস্তে এধরণের সফটওয়ারের বিকাশ ঘটে। তা সত্ত্বেও জনসংযোগের অভাবে থেমে থাকে বাংলা উইকিপিডিয়ার বিকাশ।
২০০৫ সালের মার্চ মাস নাগাদ বাংলা উইকিপিডিয়াতে ছিলো মাত্র ৫০০টি নিবন্ধ। এই সময় জনাব মুনির হাসানের উৎসাহে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের অধীনে গঠন করা হয় বাংলা উইকি নামের সংগঠন। ইন্টারনেট ভিত্তিক ইমেইল-দ্বারা পরিচালিত মেইলিং লিস্টের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে বাংলা উইকিতে সক্রিয় লেখকের সংখ্যা, আর বাড়তে থাকে বাংলা উইকির নিবন্ধের সংখ্যা।
আমাদের অবস্থান
বাংলা উইকিপিডিয়াতে এখন লেখালেখি করেন নিয়মিতভাবে অনেকেই, যারা রয়েছেন বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, জাপান সহ সারা বিশ্বে। বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ নিবন্ধ ও নিবন্ধের খসড়া সহ মোট ভুক্তির সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ফলে বাংলা উইকিপিডিয়া এখন বিশ্বের বৃহত্তম বাংলা ভাষার ওয়েবসাইট। সারা বিশ্বের ২৫০টি ভাষার উইকিপিডিয়ার মধ্যে বাংলা উইকিপিডিয়ার অবস্থান হলো ৪৩তম।
এর পাশাপাশি চলছে মুক্ত কন্টেন্ট তৈরী, ও ছবির সংকলন তৈরী করা। বাংলাদেশের অনেক ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থানের ছবি মুক্ত লাইসেন্সে পাওয়া যায় না, অনেক ছবি থাকলেও তা ব্যবহার করতে হলে ফটোগ্রাফারদের মেধাসত্ত্বের কারণে ব্যবহার করা যায় না। তাই উৎসাহী অনেকেই উইকিপিডিয়ায় দেয়ার জন্য ছবি তুলে দিচ্ছেন। গত মাসেই পুরানো ঢাকায় এরকম একটি অভিযান চালিয়ে লালবাগ কেল্লা, পরী বিবির মাজার, বড়ো কাটরা সহ অনেক স্থানের প্রায় ৩ শতাধিক ছবি তোলা হয়েছে। এই ছবিগুলো মুক্ত লাইসেন্সে ছাড়া হয়েছে, বিনা মূল্যেই যে কেউ যে কোনো কাজে এগুলো ব্যবহার কতে পারবেন।
কেন বাংলাতে বিশ্বকোষ দরকার
বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা। ১৯৫২ সালে এই বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে রক্ত দিয়েছেন সালাম বরকতেরা। এই বাংলা ভাষায় জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তাই আমাদেরই কর্তব্য। অথচ এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেটে বাংলা পিছিয়ে আছে অনেকাংশেই। ইউনিকোডভিত্তিক বাংলা ওয়েবসাইটের সংখ্যা ইন্টারনেটে হাতে গোনা। আর ইমেইল থেকে শুরু করে এসএমএস সহ নানা প্রযুক্তি ব্যবহারে আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলার চেয়ে ইংরেজিতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য অনুভব করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই বাংলা হরফের বদলে ইংরেজি হরফে লেখা হয় বাংলা। ইন্টারনেটে যেহেতু ইংরেজি ভাষার জয়জয়কার, সারা বিশ্বের অধিকাংশ তথ্য যেহেতু ইংরেজিতে, তাই আস্তে আস্তে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় বাংলার বদলে ইংরেজিই প্রাধান্য পেয়ে যাচ্ছে।
এর পাশা পাশি রয়েছে আমাদের ইতিহাস আমাদের ঐতিহ্য রক্ষার তাগিদ। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেরই রয়েছে চমৎকার সব ইতিহাস। যেমন ধরুন, এই যে আজিমপুর এলাকার নামকরণ করা হয়েছে মোগল শাহজাদা আযম, অথবা মতান্তরে নায়েবে নাজিম আজিমউশশানের নামানুসারে। পলাশী ব্যারাক এলাকা, বকশীবাজার, কারওয়ান বাজার – প্রতিটিরই নামের পেছনে আছে অনেক অনেক কাহিনী। আরো আছেন আমাদের ইতিহাসের জানা অজানা অনেক মানুষের কথা – শূণ্য পুরাণের রচয়িতা রামাই পন্ডিত, বাঁশের কেল্লার তিতুমীর, অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের প্রীতিলতা। এঁদের কথা সারা বিশ্বের অনেক বিশ্বকোষেই স্থান পায় নি। এর কারণ কিন্তু এরকম না যে, এঁরা উল্লেখযোগ্য নন। আসলে তো বিদেশীদের জন্য আমাদের দেশের অনেক তথ্যই রয়ে গেছে অজানা। সেই তথ্যকে সংরক্ষণ করতে এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরকেই।
মনে রাখতে হবে, আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে রক্ষা করার কাজটা বিদেশ থেকে এসে কেউ করে দিবে না, এটা করতে হবে আমাদের নিজেদেরই।
বাংলা উইকিপিডিয়া আমাদের এই সুযোগটা করে দিয়েছে। বাংলাদেশের ও পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি শহর, জনপদের উপরে সেখানে নিবন্ধ তৈরী করা হচ্ছে, আর তার সাথে যোগ করা হচ্ছে সেখানকার ইতিহাস। কাজটা মোটেই সহজ না, তবুও আস্তে আস্তে এগোনো হচ্ছে।
বাংলাদেশের ও পশ্চিমবঙ্গের কোটি কোটি কিশোর ও তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য তথ্যের সমন্বিত সংকলনের বড়ই অভাব। একটা পূর্ণাঙ্গ বিশ্বকোষ কিনতে হাজার হাজার টাকার দরকার হয়। তাই তা অনেকেরই নাগালের বাইরে থেকে যায়। কিন্তু উইকিপিডিয়া পাওয়া যাচ্ছে বিনা মূল্যেই, আর এর তথ্য হালনাগাদ করা হচ্ছে প্রতি নিয়তই, যা অন্য বিশ্বকোষে হয় না। উইকিপিডিয়ার তথ্য পেতে হলে ইন্টারনেট সংযোগ লাগবেই, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নাই। এমন ব্যবস্থাও করা সম্ভব, যে পুরো উইকিপিডিয়ার ছোট একটি সংস্করণ একটা কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভে, বা সিডিতে করে সংরক্ষণ করা যায়।
আমাদের আর কী করার আছে?
বাংলা উইকিকে এগিয়ে নিতে আমরা অনেক কিছু করতে পারি। এক বছর আগে বলেছিলাম, ২০০৭ এর মার্চ মাসের মধ্যে আমরা ১০ হাজার নিবন্ধ তৈরী করবো। সেই লক্ষ্যে আমরা পৌছে যাই ২০০৬ এর অক্টোবর মাসের মধ্যেই। আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য ঠিক করা হয় ১০০০ সুলিখিত নিবন্ধ তৈরী, এটার জন্য এখন কাজ চলছে। তবে আমাদের খুব অভাব হলো মুক্ত লাইসেন্সে ব্যবহার্য ছবি। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো ইন্টারনেটে অনেক স্থানে পেলেও অনুমতির অভাবে সেগুলো ব্যবহার করতে পারা যাচ্ছেনা। আমরা এর জন্য যোগাযোগ করেছি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষের সাথে, তাঁরা আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন এই ছবিগুলো ব্যবহারের অনুমতি আমরা পাবো।
আর দেশের বিভিন্ন অংশের ছবি তোলার জন্য বাংলা উইকি সংগঠনের উৎসাহী কর্মীরা এগিয়ে এসেছেন। আগেই বলেছি, গতমাসে এক দিনেই পুরানো ঢাকার মোগল আমলের সব পুরাকীর্তিগুলোর আমরা ৩ শ এর বেশি ছবি তুলেছি। সামনে পুরানো ঢাকার বাকি অংশের ছবি, এবং সেই সাথে দেশের সব অঞ্চলের সব দর্শনীয় স্থানের ছবি তোলা হবে। এই ছবি গুলো সারা বিশ্বের মানুষের জন্য বিনা মূল্যে মুক্ত লাইসেন্সের অধীনে দিয়ে দেয়া হচ্ছে।
আমাদের আরো দরকার উৎসাহী কর্মী। খুব বেশি কিছু করতে হবে না, আপনাদের প্রতিদিন ৫টা মিনিট সময় চেয়ে নিচ্ছি। শুধু ইন্টারনেটে থাকা অবস্থায় প্রতিদিন দুইটি লাইন যোগ করুন কোনো বিষয়ে, তাহলেই চলবে। আপনাদের কোনো কারিগরী কিছুই জানার দরকার নাই, কেবল যেকোনো নিবন্ধের সম্পাদনার পাতায় গেলেই চলবে। বাংলা টাইপিং না জানলেও ক্ষতি নেই, ফোনেটিক বাংলা টাইপিং এর ব্যবস্থা আমরা যোগ করতে যাচ্ছি। শুধু এই ৫টা মিনিট সময় দিন। বাংলা উইকিপিডিয়ার ওয়েবসাইটে গিয়ে অল্প কিছু যোগ করুন।
আমাদের প্রত্যেকের কাছেই কিছু না কিছু তথ্য আছে, এই ছোট ছোট তথ্যগুলোকে আমরা যদি একত্রিত করতে পারি, তাহলে কিন্তু খুব বিশাল একটা জ্ঞানের ভান্ডার গড়া সম্ভব।
ভবিষ্যতের পৃথিবী
আগামী দিনের বিশ্বকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন রয়েছে, তার মধ্যে একটা হলো, বাংলাদেশের সব গ্রামের সব স্কুলের কিশোর কিশোরীদের কাছে পৌছে গেছে কম্পিউটার প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট। এই প্রযুক্তি তারা ব্যবহার করছে পুরোপুরিই বাংলা ভাষায়। যে কোনো তথ্য জোগাড়ের প্রয়োজন হলেই তারা মুহুর্তের মধ্যে সেটা খুঁজে পাচ্ছে উইকিপিডিয়াতে। আমাদের এই সোনার বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাকীর্তি – সব কিছুর কথা আগামী দিনের প্রজন্ম জানতে পারছে উইকিপিডিয়া ঘেঁটে।
আমার এই স্বপ্ন সফল হতে বেশি দিন লাগবেনা। দরকার শুধু আমাদের একটু চেষ্টা, একটু সময় দেয়া। সোনার বাংলার সোনার মানুষেরা সেটা করেই ছাড়বে।
ধন্যবাদ, সবাইকে।
বিস্তারিতঃ
1 comment:
Hey !! Ragib. Saw ur messeges and read ur blog too. Nice effort man. Is this related to ur PhD thesis and all ??
Post a Comment